পরিবেশগত সমস্যা কী? পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমাজ জীবনে এর প্রভাব আলোচনা কর।

ভূমিকা

পরিবেশগত সমস্যা আধুনিক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ক্রমশই বিঘ্নিত হচ্ছে। এই বিঘ্নের অন্যতম বড় প্রকাশ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতি। এই পরিবর্তনের প্রভাব কেবল পরিবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সমাজের সকল স্তরে, সকল অর্থনীতিতে এবং জনজীবনের সকল স্তরে গভীর প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ, একটি সমতল ব-দ্বীপীয় দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের প্রতি বিশেষভাবে অরক্ষিত।

পরিবেশগত সমস্যা: সংজ্ঞা এবং প্রকারভেদ

পরিবেশগত সমস্যা বলতে আমরা বুঝি মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং যা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

১. জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তন হলো দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এবং আবহাওয়ার ধরণে যে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন প্রাকৃতিক কারণে হতে পারে আবার মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপ, বিশেষ করে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলেও হতে পারে।

২. বায়ু দূষণ

যখন বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাস, ধুলিকণা, ধোঁয়া ইত্যাদি বায়ুমণ্ডলে মিশে তার গুণমান নষ্ট করে, তখন তাকে বায়ু দূষণ বলে। যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া, ইটভাটা, ধুলোবালি ইত্যাদি বায়ু দূষণের প্রধান কারণ।

৩. পানি দূষণ

নদী, খাল, বিল, ঝিল, সমুদ্র ইত্যাদি জলাশয়ে যখন মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, জীবাণু ইত্যাদি মিশে তার জল ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে, তখন তাকে পানি দূষণ বলে।

৪. ভূমি দূষণ

ভূমিতে যখন ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, ঔদ্যোগিক বর্জ্য, প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ ইত্যাদি মিশে তার উর্বরতা নষ্ট করে তখন তাকে ভূমি দূষণ বলে।

৫. বন উজাড়

বিভিন্ন কারণে বনভূমি নষ্ট হওয়াকে বন উজাড় বলে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, বাসস্থানের কারণে, কৃষি কার্যক্রম ইত্যাদি কারণে ব্যাপক হারে বনভূমি কাটা পড়ছে।

৬. জীববৈচিত্র্য হ্রাস

জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, দূষণ ইত্যাদি কারণে প্রকৃতিতে বিদ্যমান প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতির সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে যা জীববৈচিত্র্য হ্রাসের কারণ।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমাজ জীবনে এর প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর আবহাওয়া প্যাটার্নে পরিবর্তন আসছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা মানুষের জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে।

৭. কৃষি

বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান ভিত্তি হলো কৃষি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্য ঘাটতি, দারিদ্র্য বৃদ্ধি, এবং খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে।

৮. খাদ্য নিরাপত্তা

কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ফলে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক মানুষের পক্ষেই পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা দুষ্কর হয়ে পড়ছে।

৯. পানি সম্পদ

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, পানির উৎস প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি সমস্যা তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জল রেগুলেটেড পানির উৎসকে দূষিত করছে যা পানীয় জলের তীব্র সংকট সৃষ্টি করছে।

১০. স্বাস্থ্য

তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানিবাহিত রোগ, খাদ্যাভাব ইত্যাদি কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়ছে। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১১. অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি

নদীভাঙন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এলাকার মানুষ তাদের বাসস্থান হারাচ্ছে এবং নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি নতুন নতুন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করছে।

১২. অর্থনীতি

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। কৃষি, মৎস্য চাষ, পর্যটন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণে অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

১৩. জীববৈচিত্র্য

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র ঝুঁকির মুখে পড়েছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় করণীয়

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা এবং এর সমাধানের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

১৪. কার্বন নির্গমন হ্রাস

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার (যেমন সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি) বৃদ্ধি করতে হবে।

১৫. অভিযোজন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন, সচেতনতা মূলক কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদি এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

উপসংহার

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। এই হুমকি মোকাবেলায় সরকার, বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষ সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। কার্বন নির্গমন হ্রাস এবং অভিযোজন কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে এই হুমকি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *