Skip to main content

পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা বলতে মূলত প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইউরোপ ও আমেরিকায় বিকশিত রাজনৈতিক দর্শন, তত্ত্ব ও ধারণাগুলোর সামগ্রিক রূপকে বোঝানো হয়। এই সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পরিক্রমায় রাষ্ট্র, সরকার, নাগরিকতা, অধিকার, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, আইন এবং সার্বভৌমত্বের মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে অসংখ্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদ তাদের গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেছেন। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে প্রধানত তিনটি যুগে ভাগ করা যায়: প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। প্রতিটি যুগ তার সময়কার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং পরবর্তী যুগের চিন্তাধারার ভিত্তি স্থাপন করেছে। প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রের ধারণা থেকে শুরু করে মধ্যযুগের ধর্মীয় প্রভাব এবং আধুনিক যুগের যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের বিকাশ—এই সবকিছুই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে এবং বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক কাঠামোকে রূপ দিয়েছে।

প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রচিন্তা

পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা হয় প্রাচীন গ্রিসে, যাকে রাষ্ট্রচিন্তার সূতিকাগার বলা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে গ্রিক চিন্তাবিদরা রাষ্ট্র ও সমাজ সংগঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে যুক্তিবাদী আলোচনা শুরু করেন। এই যুগের রাষ্ট্রচিন্তা মূলত নগর-রাষ্ট্র বা 'পলিস' (Polis) কেন্দ্রিক ছিল, যেখানে নাগরিক জীবন ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হতো। তৎকালীন সফিস্টদের যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা থেকে এর গোড়াপত্তন হলেও প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের দার্শনিক চিন্তা একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।

১. প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮-৩৪৭)

প্লেটো ছিলেন পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে প্রথম প্রভাবশালী দার্শনিক, যিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের সুসংহত চিত্র তুলে ধরেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ "দ্য রিপাবলিক"-এ তিনি ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রদান করেন।

  • ন্যায়বিচার তত্ত্ব: প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার হলো সমাজের প্রতিটি فردের নিজ নিজ যোগ্যতা ও প্রবণতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করা এবং অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করা। তিনি মানব আত্মাকে তিনটি অংশে ভাগ করেছেন: প্রজ্ঞা (reason), সাহস (spirit) এবং ক্ষুধা (appetite)। এই তিনটি গুণের ওপর ভিত্তি করে তিনি রাষ্ট্রের নাগরিকদের তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেন:

    • শাসক শ্রেণি (Rulers): যাদের মধ্যে প্রজ্ঞার প্রাধান্য রয়েছে, তারাই হবেন রাষ্ট্রের শাসক বা দার্শনিক রাজা (Philosopher-King)।
    • সৈনিক শ্রেণি (Guardians): যাদের মধ্যে সাহস ও বীরত্ব প্রধান, তারা রাষ্ট্রকে রক্ষা করবে।
    • উৎপাদক শ্রেণি (Producers): যাদের মধ্যে ক্ষুধা বা কামনা প্রধান, তারা রাষ্ট্রের বৈষয়িক চাহিদা পূরণ করবে।
  • শিক্ষাব্যবস্থা: প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিক তৈরির জন্য সুপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা অপরিহার্য। তার শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল শাসক শ্রেণিকে ন্যায়বিচার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ করে তোলা।

  • সম্পত্তি ও পরিবারের সাম্যবাদ: প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক এবং সৈনিক শ্রেণির জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পারিবারিক জীবন বিলোপ করার প্রস্তাব দেন। তার মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার শাসককে স্বার্থপর করে তোলে এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করে।

২. অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২)

অ্যারিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়, কারণ তিনিই প্রথম রাজনীতিকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালান। তিনি প্লেটোর ছাত্র হলেও তার চিন্তা ছিল অধিক বাস্তববাদী ও অভিজ্ঞতামূলক। ১৫৮টি নগর-রাষ্ট্রের সংবিধান পর্যালোচনা করে তিনি তার রাজনৈতিক তত্ত্ব প্রদান করেন।

  • রাষ্ট্রের প্রকৃতি: অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক এবং জৈব প্রতিষ্ঠান। মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব ('Man is by nature a political animal'), এবং রাষ্ট্রের মধ্যেই তার জীবনের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো নাগরিকদের জন্য একটি উন্নত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা।

  • সরকারের শ্রেণিবিভাগ: অ্যারিস্টটল দুটি নীতির ওপর ভিত্তি করে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেন: শাসকের সংখ্যা এবং শাসনের উদ্দেশ্য।

    • স্বাভাবিক রূপ (Normal Form): যখন শাসনব্যবস্থা সর্বসাধারণের কল্যাণে পরিচালিত হয়।
      • রাজতন্ত্র (Monarchy): একজনের শাসন।
      • অভিজাততন্ত্র (Aristocracy): কয়েকজনের শাসন।
      • পলিটি বা মধ্যতন্ত্র (Polity): বহু লোকের শাসন।
    • বিকৃত রূপ (Perverted Form): যখন শাসনব্যবস্থা কেবল শাসকের স্বার্থে পরিচালিত হয়।
      • স্বৈরতন্ত্র (Tyranny): রাজতন্ত্রের বিকৃত রূপ।
      • ধনিকতন্ত্র (Oligarchy): অভিজাততন্ত্রের বিকৃত রূপ।
      • গণতন্ত্র (Democracy): পলিটির বিকৃত রূপ।
  • আইনের শাসন ও বিপ্লব তত্ত্ব: অ্যারিস্টটল আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, সর্বোত্তম শাসকের শাসনের চেয়ে আইনের শাসন শ্রেয়। এছাড়া, তিনি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য বিপ্লবের কারণ ও তার প্রতিকার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তা

মধ্যযুগে (আনুমানিক ৫ম থেকে ১৫শ শতক) পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তা মূলত খ্রিস্টধর্ম এবং গির্জার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এই সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঈশ্বর এবং তার প্রতিনিধি হিসেবে পোপ ও রাজা। রাষ্ট্র ও গির্জার সম্পর্ক এই যুগের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে।

১. সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রচিন্তা (৩৫৪-৪৩০ খ্রিষ্টাব্দ)

সেন্ট অগাস্টিন তার বিখ্যাত গ্রন্থ "দ্য সিটি অফ গড" (The City of God)-এ দুই ধরনের রাষ্ট্রের ধারণা দেন।

  • ঈশ্বরের রাষ্ট্র (City of God): এটি হলো ন্যায়, শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক, যেখানে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা প্রধান। গির্জা এই রাষ্ট্রের পার্থিব প্রতিনিধি।
  • পার্থিব রাষ্ট্র (City of Man): এটি আত্মপ্রেম, লোভ এবং পাপের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। রাষ্ট্র হলো পাপ দমনের জন্য ঈশ্বরের একটি ব্যবস্থা।

অগাস্টিনের মতে, পার্থিব রাষ্ট্র তখনই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে যখন তা ঈশ্বরের আইন মেনে চলে এবং গির্জার অধীন থাকে। তিনি রাষ্ট্রকে গির্জার সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন।

২. সেন্ট টমাস একুইনাসের রাষ্ট্রচিন্তা (১২২৫-১২৭৪ খ্রিষ্টাব্দ)

সেন্ট টমাস একুইনাস ছিলেন মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক, যিনি অ্যারিস্টটলের দর্শনকে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের সাথে সমন্বয় সাধন করেন।

  • রাষ্ট্রের ভূমিকা: একুইনাস অ্যারিস্টটলের মতো রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক ও কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করেন। তার মতে, রাষ্ট্রের কাজ হলো মানুষের জাগতিক কল্যাণ নিশ্চিত করা, তবে মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আধ্যাত্মিক মুক্তি, যা গির্জার মাধ্যমে অর্জিত হয়।
  • আইনের শ্রেণিবিভাগ: একুইনাস আইনকে চার ভাগে ভাগ করেছেন:
    • শাশ্বত আইন (Eternal Law): ঈশ্বরের প্রজ্ঞা, যা সমগ্র মহাবিশ্বকে পরিচালনা করে।
    • প্রাকৃতিক আইন (Natural Law): মানুষের যুক্তির মাধ্যমে শাশ্বত আইনের যে অংশটুকু বোঝা যায়।
    • মানবিক আইন (Human Law): প্রাকৃতিক আইনের ভিত্তিতে মানুষের তৈরি আইন, যা রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বজায় রাখে।
    • ঐশ্বরিক আইন (Divine Law): ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে প্রকাশিত ঈশ্বরের আইন।

একুইনাসের মতে, রাষ্ট্রীয় আইন অবশ্যই প্রাকৃতিক ও ঐশ্বরিক আইনের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। তিনি গির্জাকে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে স্থান দিলেও রাষ্ট্রকে তার নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসিত বলে মনে করতেন।

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা

পঞ্চদশ শতকে রেনেসাঁর মাধ্যমে ইউরোপে আধুনিক যুগের সূচনা হয়। এই সময়ে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশ ঘটে, যা রাষ্ট্রচিন্তায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়।

১. নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা (১৪৬৯-১৫২৭)

ম্যাকিয়াভেলি তার বিখ্যাত গ্রন্থ "দ্য প্রিন্স" (The Prince)-এ রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ে বাস্তববাদী ও প্রয়োগবাদী ধারণা প্রদান করেন। তিনি রাজনীতিকে ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করেন।

  • ক্ষমতা ও রাষ্ট্ররক্ষা: ম্যাকিয়াভেলির মতে, শাসকের প্রধান লক্ষ্য হলো যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা অর্জন ওรักษา করা। রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য শাসক প্রয়োজনে নিষ্ঠুর, প্রতারক বা চাতুর্যপূর্ণ হতে পারেন। তার বিখ্যাত উক্তি হলো—"লক্ষ্যই উপায়ের যথার্থতা প্রমাণ করে (The end justifies the means)"
  • মানব প্রকৃতি: তিনি মনে করতেন, মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ এবং ক্ষমতালোভী। তাই শাসককে সর্বদা মানুষের মন্দ স্বভাব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

২. সামাজিক চুক্তি মতবাদ (Social Contract Theory)

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং সরকারের বৈধতা ব্যাখ্যার জন্য সামাজিক চুক্তি মতবাদ অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তারা হলেন টমাস হবস, জন লক এবং জ্যাঁ-জ্যাক রুসো। তারা মনে করতেন, রাষ্ট্র কোনো ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং জনগণের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে এর সৃষ্টি হয়েছে।

  • টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯): হবস তার "লেভিয়াথান" (Leviathan) গ্রন্থে বলেন, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন ছিল "একাকী, দরিদ্র, নোংরা, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী"। এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত অধিকার ও ক্ষমতা একজন সার্বভৌম শাসকের হাতে তুলে দেয়। হবসের সার্বভৌম শাসক ছিলেন চরম ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী।

  • জন লক (১৬৩২-১৭০৪): লককে উদারতাবাদের জনক বলা হয়। তিনি মনে করতেন, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের কিছু স্বাভাবিক অধিকার ছিল, যেমন—জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার। এই অধিকারগুলো রক্ষা করার জন্যই মানুষ চুক্তি করে সরকার গঠন করে। লকের সরকার ছিল সীমিত ও শর্তাধীন। যদি সরকার জনগণের স্বাভাবিক অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণের সেই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার রয়েছে।

  • জ্যাঁ-জ্যাক রুসো (১৭১২-১৭৭৮): রুসো তার "দ্য সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট" (The Social Contract) গ্রন্থে বলেন, মানুষ naturale অবস্থায় সুখী ও স্বাধীন ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব বৈষম্য ও সংঘাতের জন্ম দেয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে এবং তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে "সাধারণ ইচ্ছা" (General Will)-র কাছে সমর্পণ করে। রুসোর মতে, সাধারণ ইচ্ছাই হলো সার্বভৌম এবং আইন হলো সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ।

৩. সাম্প্রতিক ও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লব এবং বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে নতুন নতুন রাষ্ট্রচিন্তার উদ্ভব হয়, যার মধ্যে উদারতাবাদ, সমাজতন্ত্র ও মার্ক্সবাদ প্রধান।

  • উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তা (Liberalism): জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো চিন্তাবিদরা ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার এবং বাকস্বাধীনতার ওপর জোর দেন। তারা মনে করতেন, রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত হওয়া উচিত এবং ব্যক্তির সর্বোচ্চ বিকাশের সুযোগ করে দেওয়াই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ।

  • সমাজতান্ত্রিক ও মার্ক্সীয় রাষ্ট্রচিন্তা (Socialism and Marxism): কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) এক বৈপ্লবিক রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম দেন। তার মতে, রাষ্ট্র হলো শোষক শ্রেণির (বুর্জোয়া) হাতে শোষিত শ্রেণির (প্রলেতারিয়েত) ওপর অত্যাচার চালানোর একটি যন্ত্র। তিনি শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিলোপ এবং একটি শ্রেণিহীন, রাষ্ট্রহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।

উপসংহার

পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা এক দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময় পথ পাড়ি দিয়েছে। প্রাচীন গ্রিসের আদর্শবাদ ও বাস্তববাদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের ধর্মীয় অনুশাসন, এবং আধুনিক যুগের যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণা—প্রতিটি পর্যায়ই মানব সভ্যতার রাজনৈতিক দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে। প্লেটোর দার্শনিক রাজা, অ্যারিস্টটলের আইনের শাসন, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা, সামাজিক চুক্তি মতবাদীদের গণসার্বভৌমত্ব, এবং মার্ক্সের শ্রেণিহীন সমাজের ধারণা—এই সবগুলোই আধুনিক রাষ্ট্র ও সরকারের প্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকারের ধারণা এবং সাংবিধানিক সরকার—এসবই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার দীর্ঘ বিবর্তনের ফসল, যা আজও বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

আবুল ফজলের রাজনৈতিক চিন্তাধারা আলোচনা কর।

আবুল ফজলের রাজনৈতিক চিন্তাধারা মুঘল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রদর্শনকে এক নতুন রূপ দিয়েছিল। তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাদশাহের ঐশ্বরিক অধিকার, সুলহ-ই-কুল বা সর্বজনীন শান্তির নীতি, এবং একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা। তিনি সম্রাট আকবরের শাসনব্যবস্থাকে একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করেন, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রজার জন্য ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপর জোর দেয়। তার 'আইন-ই-আকবরী' ও 'আকবরনামা' গ্রন্থে এই চিন্তাধারার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়, যা তাকে মধ্যযুগের ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক চিন্তাবিদে পরিণত করেছে।

পড়ুন

ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ আলোচনা কর।

ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ বা ভিত্তি হলো তাওহীদ, রিসালাত এবং খিলাফত। এই আর্টিকেলে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা, মূলনীতি, শাসনব্যবস্থা এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এটি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, ন্যায়বিচার এবং জনকল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা প্রদান করে।

পড়ুন