ভূমিকা
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। দারিদ্র্য, বৈষম্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য সামাজিক ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সময়ের সাথে সাথে, এই কর্মসূচিগুলির পরিধি এবং ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটি ব্যাপক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত। আমরা বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য গৃহীত প্রধান সরকারি কর্মসূচিগুলি, তাদের উদ্দেশ্য, বাস্তবায়ন কৌশল এবং প্রভাব বিশ্লেষণ করব।
বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রকারভেদ
বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: সামাজিক সহায়তা, সামাজিক বীমা এবং শ্রম বাজার নীতিমালা।
১. সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি
এই কর্মসূচিগুলি মূলত দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠীর জন্য। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য সহায়তা, নগদ স্থানান্তর, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ভর্তুকি প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে: ভিজিডি, ভিজিএফ, ট্রেন, অ্যালোয়েন্স ফর উইডোজ এন্ড ডিজেবল্ড, প্রাথমিক শিক্ষায় উপবৃত্তি প্রদান ইত্যাদি। এই কর্মসূচিগুলির লক্ষ্য হলো জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য হ্রাস করা।
২. সামাজিক বীমা কর্মসূচি
সামাজিক বীমা কর্মসূচি মূলত চাকরিজীবীদের জন্য। এই কর্মসূচির আওতায় বেকারত্ব, অসুস্থতা, বার্ধক্য, মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে এখনও সর্বজনীন সামাজিক বীমা ব্যবস্থা চালু হয়নি। তবে, সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো কিছু সুবিধা রয়েছে। বেসরকারি খাতেও সীমিত পরিসরে কিছু সামাজিক বীমা কর্মসূচি চালু রয়েছে।
৩. শ্রম বাজার নীতিমালা
শ্রম বাজার নীতিমালা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, কর্মঘন্টা সীমাবদ্ধকরণ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি এই নীতিমালার আওতাভুক্ত। সরকার বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য ন্যায়সঙ্গত কর্মপরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা এবং দারিদ্র্য হ্রাস করা।
৪. দারিদ্র্য হ্রাস
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি করা এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হয়। নগদ স্থানান্তর, খাদ্য সহায়তা, কর্মসংস্থান কর্মসূচি ইত্যাদি দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. মানব সম্পদ উন্নয়ন
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে সরকার মানব সম্পদ উন্নয়নের চেষ্টা করছে। সুশিক্ষিত ও সুস্থ জনগোষ্ঠী দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৬. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য ন্যায়সঙ্গত সুযোগ তৈরি করে। বিশেষ করে, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
প্রধান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিসমূহ
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
৭. ভিজিডি এবং ভিজিএফ
গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র ও অতিদরিদ্র নারীদের জন্য ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) এবং ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ) কর্মসূচি দুটি গুরুত্বপূর্ণ। ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় নারীদের সংগঠিত করে তাদের আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা হয়। অন্যদিকে, ভিজিএফ কর্মসূচির মাধ্যমে খাদ্য অসুরক্ষা মোকাবেলায় সহায়তা প্রদান করা হয়।
৮. বৃত্তি ও উপবৃত্তি কর্মসূচি
দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য সরকার বিভিন্ন বৃত্তি ও উপবৃত্তি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান করা হয়। এছাড়াও, উচ্চশিক্ষার জন্যও বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
৯. স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি
সকল নাগরিকের জন্য সুলভ মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। এছাড়াও, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি কর্মসূচি, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
১০. প্রবীণ ভাতা
ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক ও দরিদ্র নাগরিকদের জন্য প্রবীণ ভাতা প্রদান করা হয়। এই ভাতার পরিমাণ সীমিত হলেও প্রবীণদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা।
১১. বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা
সমাজের অবহেলিত বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের আর্থিক সুরক্ষা প্রদানের জন্য ভাতা প্রদান করা হয়।
১২. প্রতিবন্ধী ভাতা
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য ভাতা প্রদান করা হয়।
উপসংহার
বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হাতিয়ার। দারিদ্র্য হ্রাস, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এই কর্মসূচিগুলি ভূমিকা রাখছে। তবে, সীমাবদ্ধতা দূর করে এই কর্মসূচিগুলিকে আরও কার্যকর, স্বচ্ছ এবং টেকসই করে তুলতে হবে। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং উন্নয়ন অংশীদারদের একযোগে কাজ করে এই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে হবে।