Skip to main content

সামাজিক সুবিচার প্রসঙ্গে আলোচনা কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে সামাজিক সুবিচার একটি অন্যতম মৌলিক ও বিতর্কিত ধারণা। সাধারণভাবে, সামাজিক সুবিচার বলতে বোঝায় একটি সমাজের মধ্যে সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকারের ন্যায্য ও equuitable বণ্টন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ, আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি সমান আচরণ এবং সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। একটি আদর্শ সমাজে সামাজিক সুবিচার শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

সামাজিক সুবিচারের ধারণাটি কেবল আইনগত বা অর্থনৈতিক समानताর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সমতা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। এর মাধ্যমে সমাজের দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করা হয় এবং তাদের আত্মবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ তৈরি করা হয়। মূলত, সামাজিক সুবিচার একটি নৈতিক দায়বদ্ধতা যা রাষ্ট্র ও সমাজকে সকল নাগরিকের কল্যাণ সাধনে উদ্বুদ্ধ করে। এই আলোচনায় সামাজিক সুবিচারের ধারণা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি, এর গুরুত্ব এবং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ ও উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে।

সামাজিক সুবিচারের ধারণা

সামাজিক সুবিচার একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এর মূল কথা হলো সমাজে ন্যায্যতা ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা।

  • সম্পদের ন্যায্য বণ্টন: সামাজিক সুবিচারের একটি প্রধান দিক হলো সমাজের ভৌত ও অভৌত সম্পদ, যেমন—ভূমি, অর্থ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। এর অর্থ এই নয় যে সবাই সমান সম্পদ পাবে, বরং এর অর্থ হলো সম্পদের বণ্টনে এমন কোনো বৈষম্য থাকবে না যা ব্যক্তির যোগ্যতা বা প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে।

  • সুযোগের সমতা: সামাজিক সুবিচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা তৈরি করা। অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক অগ্রগতির সমান সুযোগ লাভ করতে পারে।

  • অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা: সামাজিক সুবিচার प्रत्येक নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং মানবিক মর্যাদা রক্ষার ওপর জোর দেয়। এটি নিশ্চিত করে যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে যেন শোষণ, বঞ্চনা বা নিপীড়নের শিকার হতে না হয়।

  • অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র: একটি সমাজে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সকলের, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এটি রাজনৈতিক সুবিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে সকল নাগরিকের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়।

সুতরাং, সামাজিক সুবিচার কেবল বৈষম্য দূরীকরণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি ইতিবাচক ধারণা যা এক শোষণমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমताভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের কথা বলে।

সামাজিক সুবিচারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

সামাজিক সুবিচারের ধারণাটি প্রাচীনকাল থেকেই রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এই ধারণাটিকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রাচীন গ্রিক দর্শনে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল সর্বপ্রথম ন্যায়বিচার বা সুবিচারের পদ্ধতিগত আলোচনা করেন। প্লেটো তাঁর "The Republic" গ্রন্থে ন্যায়বিচারকে আদর্শ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, ন্যায়বিচার হলো সমাজের প্রতিটি শ্রেণি যখন নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে এবং অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। অন্যদিকে, অ্যারিস্টটল আনুপাতিক ও সংশোধনমূলক—এই দুই ধরনের ন্যায়বিচারের কথা বলেছেন। তার মতে, সম্পদ ও সম্মান বণ্টন হওয়া উচিত যোগ্যতা অনুযায়ী (আনুপাতিক ন্যায়বিচার) এবং আইন লঙ্ঘিত হলে তার প্রতিকার করা উচিত (সংশোধনমূলক ন্যায়বিচার)।

মধ্যযুগে ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা ন্যায়বিচারের ধারণাকে প্রভাবিত করে। ইসলামী দর্শনে 'আদল' বা ন্যায়বিচারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেখানে শাসক ও সাধারণ মানুষ উভয়ের জন্যই ন্যায়পরায়ণ আচরণ বাধ্যতামূলক।

আধুনিক যুগে শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক সুবিচারের ধারণাটি নতুন মাত্রা লাভ করে। কার্ল মার্ক্স শ্রেণি শোষণের অবসানের মাধ্যমে এক সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, যা সামাজিক সুবিচারের এক বৈপ্লবিক রূপ। পরবর্তীকালে, জন রলস (John Rawls) তাঁর "A Theory of Justice" গ্রন্থে সামাজিক সুবিচারের এক প্রভাবশালী তত্ত্ব প্রদান করেন, যা আজও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।

বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন মানবাধিকার আন্দোলন, নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রাম সামাজিক সুবিচারের ধারণাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রেও সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছিল, যা এই ধারণার সর্বজনীন আবেদনকে প্রতিফলিত করে।

বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদের দৃষ্টিতে সামাজিক সুবিচার

বিভিন্ন যুগের রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা সামাজিক সুবিচারকে নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, যা এই ধারণাটিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

১. প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো সামাজিক সুবিচারকে একটি নৈতিক ধারণা হিসেবে দেখেছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "The Republic"-এ তিনি বলেছেন, ন্যায়বিচার হলো রাষ্ট্রের आत्मा। প্লেটোর মতে, মানবাত্মার তিনটি গুণ রয়েছে— প্রজ্ঞা (wisdom), সাহস (courage), এবং সংযম বা প্রবৃত্তি (appetite)। এই তিনটি গুণের ভিত্তিতে সমাজে তিনটি শ্রেণির উদ্ভব হয়:

  • শাসক শ্রেণি: যাদের মধ্যে প্রজ্ঞার প্রাধান্য রয়েছে।
  • সৈনিক শ্রেণি: যাদের মধ্যে সাহসের প্রাধান্য বিদ্যমান।
  • উৎপাদক শ্রেণি: যারা প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়।

প্লেটোর দৃষ্টিতে, সামাজিক সুবিচার তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন সমাজের এই তিনটি শ্রেণি নিজ নিজ যোগ্যতা ও গুণ অনুযায়ী তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে এবং একে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। তার কাছে সুবিচার হলো কর্মविशेषীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মধ্যে একটি सामंजस्यপূর্ণ অবস্থা তৈরি করা।

২. অ্যারিস্টটলের ন্যায়বিচার তত্ত্ব

প্লেটোর ছাত্র অ্যারিস্টটল সামাজিক সুবিচারকে আরও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তিনি সুবিচারকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন:

  • বণ্টনমূলক সুবিচার (Distributive Justice): এর মূল কথা হলো রাষ্ট্রের সম্পদ, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা নাগরিকদের মধ্যে তাদের যোগ্যতা ও অবদান অনুযায়ী আনুপাতিক হারে বণ্টন করা।
  • সংশোধনমূলক সুবিচার (Corrective Justice): এটি মূলত আইনগত সুবিচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি কোনো ব্যক্তি অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে বা কোনো অপরাধ করে, তবে রাষ্ট্র আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সেই ভুলের সংশোধন করবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রতিকার দেবে।

অ্যারিস্টটলের মতে, সুবিচার হলো সমতা রক্ষা করা, তবে এই সমতা যান্ত্রিক নয়, বরং আনুপাতিক।

৩. জন রলসের ন্যায়বিচার তত্ত্ব

আধুনিককালের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জন রলস তাঁর "A Theory of Justice" (1971) গ্রন্থে সামাজিক সুবিচার বিষয়ে এক যুগান্তকারী তত্ত্ব প্রদান করেছেন। তিনি সামাজিক সুবিচারকে 'ন্যায্যতা হিসেবে সুবিচার' (Justice as Fairness) বলে অভিহিত করেছেন। রলসের মতে, একটি справедливый সমাজ গঠনের জন্য কিছু মৌলিক নীতি থাকা প্রয়োজন, যা সমাজের সকল সদস্যের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

রলস দুটি প্রধান নীতির কথা বলেছেন:

  • প্রথম নীতি (The Liberty Principle): প্রত্যেক ব্যক্তির সর্বাধিক মৌলিক স্বাধীনতার সমান অধিকার থাকবে, যা অন্যদের অনুরূপ স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা।
  • দ্বিতীয় নীতি (The Difference and Fair Opportunity Principle): সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দুটি শর্তে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। প্রথমত, এই বৈষম্যগুলো সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত সদস্যদের সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদান করবে (পার্থক্য নীতি বা Difference Principle)। দ্বিতীয়ত, সকল পদ ও অবস্থান সকলের জন্য ন্যায্য সুযোগের সমতার ভিত্তিতে উন্মুক্ত থাকবে (সুযোগের ন্যায্য সমতা নীতি বা Fair Equality of Opportunity Principle)।

রলসের তত্ত্বটি স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, যা আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার ভিত্তি স্থাপন করেছে।

সামাজিক সুবিচারের গুরুত্ব

একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামাজিক সুবিচারের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কেবল একটি নৈতিক আদর্শই নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।

  • সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা: যখন সমাজে সম্পদ ও সুযোগের ন্যায্য বণ্টন হয় এবং সকল নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করে, তখন অসন্তোষ ও সংঘাতের সম্ভাবনা কমে আসে। সামাজিক সুবিচার সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

  • বৈষম্য হ্রাস ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি: সামাজিক সুবিচার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করে। এটি সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে এবং প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে সহায়তা করে।

  • মানবাধিকার রক্ষা: সামাজিক সুবিচার মৌলিক মানবাধিকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি মানুষের জীবন ধারণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও নিরাপত্তার মতো মৌলিক অধিকারগুলোকে সুরক্ষিত করে।

  • গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ: একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর। সামাজিক সুবিচার যখন নিশ্চিত হয়, তখন নাগরিকরা রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাশীল হয় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত বোধ করে।

  • অর্থনৈতিক উন্নয়ন: সামাজিক সুবিচার অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। যখন সকল নাগরিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ পায়, তখন মানবসম্পদের পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয়, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে।

  • শোষণমুক্ত সমাজ গঠন: সামাজিক সুবিচারের মূল লক্ষ্য হলো এক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে শক্তিশালী দুর্বলকে শোষণ করতে পারবে না এবং প্রত্যেকে তার শ্রমের ন্যায্য ফল ভোগ করবে।

বাংলাদেশে সামাজিক সুবিচার

১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যার অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল সকল নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ সংবিধানেও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে नागरिकोंর জন্য ১৮টি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে বৈষম্যহীনতা এবং সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগের কথা উল্লেখ রয়েছে।

এতদসত্ত্বেও, বাংলাদেশে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সম্পদে অসম বণ্টন, দুর্নীতি, এবং আইনি প্রক্রিয়ার দুর্বলতা সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয় ও সম্পদের ব্যবধান ক্রমাগত বাড়ছে, যা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে। নারী, শিশু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তবে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির (Social Safety Net Programs) আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং দুস্থদের জন্য খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন আইন ও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

তবে এসব কর্মসূচি সত্ত্বেও সামাজিক সুবিচার পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইনের শাসন নিশ্চিত করা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

উপসংহার

সামাজিক সুবিচার একটি গতিশীল এবং বহুমাত্রিক ধারণা, যা একটি সভ্য ও মানবিক সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন এবং এর বাস্তবায়নের পথনির্দেশ করেছেন। সামাজিক সুবিচারের মূল লক্ষ্য হলো বৈষম্য ও শোষণমুক্ত এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার যোগ্যতা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী বিকশিত হওয়ার সমান সুযোগ পাবে।

আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সামাজিক সুবিচার শুধু একটি নৈতিক আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব। এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাংবিধানিক অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সমताমূলক সমাজ গঠনে সফল হলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

আবুল ফজলের রাজনৈতিক চিন্তাধারা আলোচনা কর।

আবুল ফজলের রাজনৈতিক চিন্তাধারা মুঘল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রদর্শনকে এক নতুন রূপ দিয়েছিল। তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাদশাহের ঐশ্বরিক অধিকার, সুলহ-ই-কুল বা সর্বজনীন শান্তির নীতি, এবং একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা। তিনি সম্রাট আকবরের শাসনব্যবস্থাকে একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করেন, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রজার জন্য ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপর জোর দেয়। তার 'আইন-ই-আকবরী' ও 'আকবরনামা' গ্রন্থে এই চিন্তাধারার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়, যা তাকে মধ্যযুগের ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক চিন্তাবিদে পরিণত করেছে।

পড়ুন

ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ আলোচনা কর।

ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদ বা ভিত্তি হলো তাওহীদ, রিসালাত এবং খিলাফত। এই আর্টিকেলে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা, মূলনীতি, শাসনব্যবস্থা এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এটি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, ন্যায়বিচার এবং জনকল্যাণের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি আদর্শিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা প্রদান করে।

পড়ুন