ভূমিকা: সৃজনশীল নামের বিভীষিকা
“সবকিছু পারি, কিন্তু সৃজনশীলের ‘গ’ আর ‘ঘ’ নম্বরটা ঠিকমতো লিখতে পারি না”, “উদ্দীপকটাই বুঝি না, উত্তর লিখব কীভাবে?”, “অনেক বড় করে লিখি, কিন্তু স্যার নম্বর দেয় না”—এই কথাগুলো কি তোমার মনের কথা?
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থ করার প্রবণতা থেকে বের করে এনে তাদের চিন্তাশক্তি এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। কিন্তু সঠিক নির্দেশনার অভাবে এই সৃজনশীলই এখন অনেকের কাছে এক বিভীষিকার নাম। অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীও শুধু সৃজনশীল প্রশ্ন লেখার সঠিক কৌশল না জানার কারণে পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ে।
কিন্তু সত্যিটা হলো, সৃজনশীল প্রশ্ন লেখাটা কোনো রকেট সায়েন্স নয়। এটি একটি শিল্প এবং একটি কৌশল। আর যেকোনো কৌশলই সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত করা সম্ভব।
এই আর্টিকেলে আমরা সৃজনশীল প্রশ্ন লেখার ভয়কে জয় করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ, স্টেপ-বাই-স্টেপ কৌশল নিয়ে আলোচনা করব। জ্ঞানমূলক (ক), অনুধাবন (খ), প্রয়োগ (গ) এবং উচ্চতর দক্ষতা (ঘ)—প্রতিটি ধাপ কীভাবে লিখতে হবে, কী কী ভুল এড়িয়ে চলতে হবে এবং কীভাবে একটি সাধারণ উত্তরকে অসাধারণ উত্তরে পরিণত করা যায়, তার সবকিছুই আমরা হাতে-কলমে শিখব।
চলো, সৃজনশীলের ভয়কে আজ থেকে ছুটিতে পাঠানো যাক!
ধাপ ১: প্রশ্ন বোঝার খেলা—উদ্দীপকের পোস্টমর্টেম
সৃজনশীলে ভালো করার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো প্রশ্ন এবং উদ্দীপক সঠিকভাবে বোঝা। উত্তর লেখার আগে অন্তত ২-৩ মিনিট সময় নিয়ে এই কাজটি করো।
- উদ্দীপকটি কোন গল্প বলছে? উদ্দীপকটি মনোযোগ দিয়ে পড়ো এবং বোঝার চেষ্টা করো এর মূলভাব বা কেন্দ্রীয় চরিত্রটি কী বার্তা দিচ্ছে। এটি কি কোনো সামাজিক সমস্যা, কোনো বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, নাকি কোনো ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা বলছে?
- পাঠ্যবইয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন: উদ্দীপকটি পড়ার সাথে সাথে চিন্তা করো, “আমার পাঠ্যবইয়ের কোন গল্প, কবিতা বা অধ্যায়ের সাথে এর মিল রয়েছে?”। যেমন: উদ্দীপকে যদি দুই বন্ধুর মধ্যে স্বার্থপরতা নিয়ে কোনো ঘটনা থাকে, তাহলে তোমার মাথায় সাথে সাথে ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার উপেন চরিত্রটি চলে আসা উচিত। এই সংযোগ স্থাপন করতে পারাটাই অর্ধেক কাজ।
- প্রশ্নগুলো কী চায়? প্রতিটি প্রশ্ন (ক, খ, গ, ঘ) মনোযোগ দিয়ে পড়ো এবং নিশ্চিত হও তুমি ঠিক কী উত্তর দেবে। অনেক সময় ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন না বুঝেই উত্তর লেখা শুরু করে দেয়।
ধাপ ২: জ্ঞানমূলক (ক) এবং অনুধাবন (খ)—ভিত্তি হোক মজবুত
এই দুটি অংশে ভালো নম্বর তোলা সবচেয়ে সহজ, কিন্তু এখানেই অনেকে ভুল করে।
জ্ঞানমূলক (ক) নম্বর প্রশ্ন (নম্বর: ১)
- কী ধরনের প্রশ্ন হয়? “সুভা’র বাবার নাম কী?”, “সালোকসংশ্লেষণ কী?”—এই ধরনের সরাসরি তথ্যভিত্তিক প্রশ্ন।
- কীভাবে উত্তর লিখবে?
- এক কথায় বা এক বাক্যে উত্তর: এর উত্তর হবে একদম সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট। কোনো প্রকার ভূমিকা বা অপ্রয়োজনীয় কথা লেখা যাবে না।
- বানান নির্ভুল রাখো: যেহেতু উত্তরটি খুব ছোট, তাই একটি বানান ভুলও পরীক্ষকের চোখে পড়ে।
- উদাহরণ:
- প্রশ্ন: ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধটি কোন গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে?
- ভুল উত্তর: মোতাহের হোসেন চৌধুরী একজন বিখ্যাত লেখক। তিনি অনেক বই লিখেছেন। তার মধ্যে ‘সংস্কৃতি কথা’ অন্যতম। এই বই থেকেই ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে।
- সঠিক উত্তর: ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধটি মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
অনুধাবনমূলক (খ) নম্বর প্রশ্ন (নম্বর: ২)
- কী ধরনের প্রশ্ন হয়? “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’—কথাটি ব্যাখ্যা কর”, “লোহাকে চুম্বক পদার্থ বলা হয় কেন?”—এই ধরনের ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন।
- কীভাবে উত্তর লিখবে?
- দুই প্যারা কৌশল: অনুধাবনের উত্তর সবসময় দুটি প্যারায় লিখবে। এটি পরীক্ষককে বুঝতে সাহায্য করে যে তুমি প্রশ্নের দুটি অংশই (জ্ঞান ও অনুধাবন) সঠিকভাবে বুঝেছ।
- প্রথম প্যারা (জ্ঞান অংশ): প্রথম প্যারায় প্রশ্নটির মূল উত্তর বা সংজ্ঞাটি এক বা দুই লাইনে লিখবে। এটি হলো তোমার উত্তরের জ্ঞানমূলক অংশ (এর জন্য ১ নম্বর)।
- দ্বিতীয় প্যারা (অনুধাবন/ব্যাখ্যা অংশ): দ্বিতীয় প্যারায় প্রথম প্যারার কথাটিকে ৩-৫টি বাক্যে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করবে। পাঠ্যবইয়ের আলোকে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেবে। এটি হলো তোমার অনুধাবনমূলক অংশ (এর জন্য ১ নম্বর)।
- উদাহরণ:
- প্রশ্ন: “অনর্থক দণ্ড দেওয়া ভালো নয়”—উক্তিটি ব্যাখ্যা কর। (‘পড়ে পাওয়া’ গল্পের আলোকে)
- সঠিক উত্তর:
(প্যারা ১ – জ্ঞান) উক্ত উক্তিটির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া বা সামান্য অপরাধের জন্য কাউকে বড় শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।(প্যারা ২ – অনুধাবন) ‘পড়ে পাওয়া’ গল্পে লেখক এবং তার সঙ্গীরা যখন বাক্সটি পেয়েছিল, তখন তাদের মধ্যে একজন এটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু লেখক এবং বাদল এর বিরোধিতা করে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল, এই বাক্সের প্রকৃত মালিক এটি হারিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত আছেন। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া বাক্সের মালিক নির্ধারণ করা যেমন কঠিন, তেমনি ভুল মানুষকে বাক্স দিয়ে দেওয়াটাও এক ধরনের অন্যায়। তাই তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সঠিক মালিককে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে ভুল বোঝার কারণে বা নির্দোষ হয়েও বাক্সটি না পাওয়ার কারণে কষ্ট পেতে না হয়। এর মাধ্যমেই লেখকের বিচক্ষণতা এবং নৈতিক দায়িত্ববোধ ফুটে উঠেছে।
ধাপ ৩: প্রয়োগ (গ) এবং উচ্চতর দক্ষতা (ঘ)—যেখানে আসল খেলা
এই দুটি অংশেই ছাত্রছাত্রীরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে। এখানেই একজন সাধারণ এবং একজন সেরা ছাত্রের মধ্যে পার্থক্য গড়ে ওঠে।
প্রয়োগমূলক (গ) নম্বর প্রশ্ন (নম্বর: ৩)
- কী ধরনের প্রশ্ন হয়? “উদ্দীপকের ‘করিম সাহেব’ চরিত্রটি ‘নিমগাছ’ গল্পের কোন দিকটিকে নির্দেশ করে? ব্যাখ্যা কর।” এই ধরনের প্রশ্নে উদ্দীপকের সাথে পাঠ্যবইয়ের কোনো চরিত্রের বা ঘটনার সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য দেখাতে বলা হয়।
- কীভাবে উত্তর লিখবে?
- তিন প্যারা কৌশল: প্রয়োগের উত্তর তিনটি প্যারায় লিখলে তা একটি সুন্দর কাঠামো পায় এবং পরীক্ষকের বুঝতে সুবিধা হয়।
- প্রথম প্যারা (ভূমিকা/জ্ঞান): প্রথম প্যারায় সরাসরি প্রশ্নের উত্তরটি দেবে। অর্থাৎ, উদ্দীপকের সাথে পাঠ্যবইয়ের কোন চরিত্রের বা ঘটনার মিল বা অমিল রয়েছে, তা এক বা দুই লাইনে উল্লেখ করবে।
- দ্বিতীয় প্যারা (ব্যাখ্যা/পাঠ্যবই): দ্বিতীয় প্যারায় তুমি যে মিল বা অমিলের কথা বলেছ, সেটি পাঠ্যবইয়ের আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবে। অর্থাৎ, পাঠ্যবইয়ের সেই চরিত্র বা ঘটনাটি কেমন ছিল, তা বর্ণনা করবে।
- তৃতীয় প্যারা (সমন্বয়/উদ্দীপক): তৃতীয় প্যারায় উদ্দীপকের ঘটনাটি বর্ণনা করবে এবং দেখাবে যে কীভাবে এই ঘটনাটি তোমার পাঠ্যবইয়ের ব্যাখ্যার সাথে মিলে যাচ্ছে বা অমিল তৈরি করছে। শেষে একটি সিদ্ধান্তমূলক বাক্য দিয়ে উত্তর শেষ করবে।
উচ্চতর দক্ষতা (ঘ) নম্বর প্রশ্ন (নম্বর: ৪)
- কী ধরনের প্রশ্ন হয়? “উদ্দীপকটি কি ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার মূলভাবকে সম্পূর্ণ ধারণ করতে পেরেছে? তোমার মতের সপক্ষে যুক্তি দাও।”—এই ধরনের প্রশ্নে একটি বিষয়ের সার্বিক বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন বা তাৎপর্য তুলে ধরতে বলা হয়।
- কীভাবে উত্তর লিখবে?
- চার প্যারা কৌশল (প্রস্তাবিত): এটি সবচেয়ে কার্যকর কৌশল।
- প্রথম প্যারা (ভূমিকা/মতামত): প্রশ্নের উত্তরে তোমার অবস্থান কী (হ্যাঁ/না, একমত/একমত নই), তা সরাসরি এবং স্পষ্টভাবে উল্লেখ করবে। এটিই তোমার উচ্চতর দক্ষতার পরিচায়ক।
- দ্বিতীয় প্যারা (পাঠ্যবইয়ের আলোকে সার্বিক আলোচনা): এখানে উদ্দীপককে সাময়িকভাবে ভুলে গিয়ে, প্রশ্নের মূল বিষয়বস্তুটি (যেমন: ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার মূলভাব) পাঠ্যবইয়ের আলোকে গভীরভাবে আলোচনা করবে।
- তৃতীয় প্যারা (উদ্দীপকের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ): এই প্যারায় উদ্দীপকের ঘটনা বা ভাবকে পাঠ্যবইয়ের সার্বিক আলোচনার সাথে তুলনা করবে। দেখাবে যে, উদ্দীপকে হয়তো মূল ভাবের একটি অংশ ফুটে উঠেছে, কিন্তু আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক (যা তুমি দ্বিতীয় প্যারায় আলোচনা করেছ) অনুপস্থিত।
- চতুর্থ প্যারা (চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত/উপসংহার): সব আলোচনার উপর ভিত্তি করে প্রথম প্যারায় দেওয়া তোমার মতামতের সপক্ষে একটি শক্তিশালী এবং যৌক্তিক উপসংহার টানবে।
সৃজনশীলে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কিছু গোপন টিপস
- সময়ের সঠিক বণ্টন: একটি সৃজনশীলের জন্য প্রায় ২০-২২ মিনিট সময় পাবে। এটিকে ভাগ করে নাও: ক (১ মিনিট), খ (৪ মিনিট), গ (৮ মিনিট), ঘ (৯ মিনিট)।
- প্যারা করে লেখো: প্রতিটি উত্তর প্যারা করে লিখলে খাতা দেখতে সুন্দর লাগে এবং পরীক্ষকের পড়তে সুবিধা হয়।
- অপ্রয়োজনীয় কথা বর্জন করো: সৃজনশীল মানেই বিশাল করে লেখা নয়, সৃজনশীল মানে প্রাসঙ্গিকভাবে লেখা। মূল বিষয়ের বাইরে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা লিখে খাতা ভরানোর চেষ্টা করবে না।
- উদ্ধৃতি ব্যবহার করো (বাংলা/ধর্মের ক্ষেত্রে): উত্তরের প্রাসঙ্গিক অংশে কবিতার লাইন বা মনিষীদের উক্তি ব্যবহার করলে উত্তরের মান বেড়ে যায়।
- চিত্র আঁকো (বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে): বিজ্ঞানের উত্তরে, বিশেষ করে ‘গ’ এবং ‘ঘ’ তে, প্রয়োজন অনুযায়ী পেন্সিল দিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন চিত্র এঁকে দিলে তা তোমাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে।
উপসংহার
সৃজনশীল প্রশ্ন কোনো ভয়ের বিষয় নয়, এটি তোমার চিন্তাশক্তিকে প্রকাশ করার একটি চমৎকার সুযোগ। প্রথম দিকে হয়তো একটু কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু উপরের কৌশলগুলো অনুসরণ করে নিয়মিত অনুশীলন করলে তুমিও হয়ে উঠতে পারো একজন সৃজনশীল লেখার মাস্টার।
মনে রাখবে, অনুশীলনই নিখুঁত করে তোলে। তাই আজ থেকেই তোমার পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে দেওয়া সৃজনশীল প্রশ্নগুলো এই নিয়ম মেনে লেখার অভ্যাস শুরু করো। খুব শীঘ্রই দেখবে, সৃজনশীলই তোমার পরীক্ষার সবচেয়ে বেশি নম্বর তোলার জায়গায় পরিণত হয়েছে।
শুভকামনা!