বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচনে গৃহীত পদক্ষেপ আলোচনা কর।
ভূমিকা
স্বাধীনতার পর থেকেই দারিদ্র্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আর্থ-সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি এবং সীমিত সম্পদ নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের জন্য দারিদ্র্য বিমোচন ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। সরকার এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) সমন্বিত ও বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৬ সালেও ২৪.৩ শতাংশ ছিল। একই সময়ে অতি-দারিদ্র্যের হার ১২.৯ শতাংশ থেকে কমে ৫.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এই সাফল্য একদিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, নীতিগত ধারাবাহিকতা এবং তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (PRSP), সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি এবং কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এর পাশাপাশি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো, বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর, বিশেষত নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বিপ্লব এনেছে।
এই সামগ্রিক আলোচনায় বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রধান প্রধান পদক্ষেপসমূহ, এই পদক্ষেপগুলোর ফলে অর্জিত সাফল্য, বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং একটি দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারি পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র্য বিমোচনকে জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপ মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক সুরক্ষা প্রদান এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। প্রধান সরকারি পদক্ষেপগুলো নিচে আলোচনা করা হলো।
১. পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও কৌশলপত্র
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পিত উন্নয়নের ধারা অনুসরণ করে আসছে। দারিদ্র্য বিমোচন প্রতিটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল।
- প্রথম থেকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা: এই পরিকল্পনাগুলোতে কৃষি উন্নয়ন, শিল্পায়ন, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য কমানোর উপর জোর দেওয়া হয়।
- দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (Poverty Reduction Strategy Paper - PRSP): একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সরকার "A National Strategy for Economic Growth, Poverty Reduction and Social Development" শিরোনামে PRSP প্রণয়ন করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বেসরকারি খাতের বিকাশ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য targeted কর্মসূচি গ্রহণ করা।
- অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫): বর্তমান এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
২. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি (Social Safety Net Programmes - SSNP)
দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং আকস্মিক দুর্যোগ বা অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবেলায় সক্ষম করে তোলার জন্য সরকার একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলেছে। বর্তমানে দেশে ছোট-বড় শতাধিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- বয়স্ক ভাতা: দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ ও দরিদ্র ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে এই কর্মসূচি চালু করা হয়।
- বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা দুঃস্থ মহিলা ভাতা: বিধবা এবং স্বামী পরিত্যক্তা দরিদ্র নারীদের আর্থিক সুরক্ষা প্রদানের জন্য এই ভাতা চালু করা হয়েছে।
- অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা এই কর্মসূচির লক্ষ্য।
- মাতৃত্বকালীন ভাতা: গর্ভবতী ও দুগ্ধদায়ী মায়েদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নতির জন্য এই ভাতা প্রদান করা হয়।
- ভিজিডি (Vulnerable Group Development): অতিদরিদ্র নারীদের খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার একটি সমন্বিত কর্মসূচি।
- কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা)/টাকা (কাবিটা): শুষ্ক মৌসুমে যখন গ্রামীণ এলাকায় কাজের অভাব দেখা দেয়, তখন অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।
- অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (EGPP): বছরের নির্দিষ্ট সময়ে অতিদরিদ্র পরিবারগুলোকে স্বল্পমেয়াদী কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
এই কর্মসূচিগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
৩. গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন
গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং দারিদ্র্য কমানোর অন্যতম প্রধান কৌশল হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সরকার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (LGED) এবং অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে দেশব্যাপী গ্রামীণ রাস্তা, সেতু, কালভার্ট, হাট-বাজার এবং সেচ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। এর ফলে:
- কৃষিপণ্য সহজে বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে।
- গ্রামীণ এলাকায় অকৃষি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানুষের যাতায়াত সহজ হয়েছে।
"আমার বাড়ি আমার খামার" এবং "পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক" এর মতো উদ্যোগগুলোও গ্রামীণ দরিদ্রদের সংগঠিত করে সঞ্চয় বৃদ্ধি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে।
৪. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভাঙার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অপরিহার্য। সরকার এই দুটি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে।
- শিক্ষাখাত: প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করা, শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ, এবং বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি কর্মসূচি শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার বাড়িয়েছে। এর ফলে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং बाल্যবিবাহ কমেছে।
- স্বাস্থ্যখাত: গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান কর্মসূচি এবং পুষ্টি কার্যক্রমের ফলে গড় আয়ু বেড়েছে এবং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
৫. কৃষি খাতের উন্নয়ন
বাংলাদেশের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষ গ্রামে বাস করে এবং কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই কৃষি খাতের উন্নয়ন দারিদ্র্য বিমোচনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- কৃষি উপকরণে (সার, বীজ, বিদ্যুৎ) ভর্তুকি প্রদান।
- উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা।
- কৃষিঋণ সহজলভ্য করা।
- কৃষি সম্প্রসারণ সেবার মাধ্যমে কৃষকদের কাছে নতুন প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া।
এইসব উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রামীণ আয় বাড়াতেও সাহায্য করেছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে বেসরকারি ও এনজিওদের ভূমিকা
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (Non-Governmental Organization - NGO) এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে যে সমস্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি সেবা পৌঁছানো কঠিন, সেখানে এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
১. ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি (Microcredit Programs)
বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের ইতিহাসে ক্ষুদ্রঋণ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃত। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এই মডেলকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছে। ক্ষুদ্রঋণের মূল ধারণা হলো জামানতবিহীন ক্ষুদ্র আকারের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে নারীদের, আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা। এর মাধ্যমে:
- দরিদ্র নারীরা হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপশু পালন, কুটির শিল্প এবং ছোট ব্যবসার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন।
- পরিবারে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নারী ক্ষমতায়নে ভূমিকা রেখেছে।
- গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
২. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান
এনজিওগুলো সরকারি কার্যক্রমের পরিপূরক হিসেবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
- শিক্ষা: ব্র্যাকের উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ঝরে পড়া শিশুদের এবং যেসব শিশু প্রচলিত ধারার স্কুলে যেতে পারে না, তাদের শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন এনজিও বয়স্ক শিক্ষা, জীবনমুখী শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে।
- স্বাস্থ্য: এনজিওগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মী এবং ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। যা তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতিতে সহায়তা করেছে।
৩. দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি
এনজিওগুলো বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিমূলক ও কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। সেলাই, হস্তশিল্প, মোবাইল ফোন মেরামত, কম্পিউটার প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের আত্মকর্মসংস্থানের পথ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া, অনেক এনজিও নিজেদের সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
৪. দুর্যোগ মোকাবেলা ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে এনজিওগুলো দুর্যোগের সময় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা সহনশীল ফসল চাষ, উন্নত চুলা বিতরণ এবং দুর্যোগ সহনীয় ঘর নির্মাণে সহায়তা করছে।
গৃহীত পদক্ষেপের সাফল্য ও অর্জন
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে, যা আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃতি পেয়েছে।
- দারিদ্র্যের হার হ্রাস: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার কমে ১৮.৭ শতাংশে এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এক দশক আগেও এই হার অনেক বেশি ছিল।
- মানব উন্নয়ন সূচকে উন্নতি: গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এবং স্কুলে ভর্তির হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হওয়ার মতো বিষয়গুলো মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অগ্রগতি প্রমাণ করে।
- খাদ্য নিরাপত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা: কৃষিখাতে সবুজ বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
- সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDG) অর্জন: বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের আগেই দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনাসহ বেশ কয়েকটি এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনের পথেও দেশ এগিয়ে চলেছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে চ্যালেঞ্জসমূহ
উল্লেখযোগ্য সাফল্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়া এখনও বেশ কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে না পারলে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
১. আয় বৈষম্য
দারিদ্র্যের হার কমলেও ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয় বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্ট অনুযায়ী, জিনি সহগ (Gini Coefficient), যা আয় বৈষম্য পরিমাপ করে, ২০১৬ সালের ০.৪৮২ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ০.৪৯৯ হয়েছে। এর অর্থ হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না।
২. জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন এবং লবণাক্ততা প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষকে সহায়-সম্বলহীন করে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এবং চরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৩. নগর দারিদ্র্য
দ্রুত নগরায়ণের ফলে শহরে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়, বস্তিবাসী ও ভাসমান মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামে কাজ হারিয়ে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে বহু মানুষ শহরে পাড়ি জমাচ্ছে, কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত বাসস্থান, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। ফলে এক নতুন ধরনের নগর দারিদ্র্য প্রকট আকার ধারণ করছে।
৪. সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতি
দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে تخصیصকৃত সম্পদের অপচয় ও দুর্নীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় প্রকৃত দরিদ্রদের বাদ দিয়ে সচ্ছল ব্যক্তিরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। সুশাসনের অভাব এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি কর্মসূচির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
৫. কর্মসংস্থানের গুণগত মান
বেকারত্ব কমলেও কর্মসংস্থানের গুণগত মান একটি উদ্বেগের বিষয়। দেশের শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, যেখানে কাজের কোনো নিরাপত্তা, নির্দিষ্ট মজুরি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই। মানসম্মত ও শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা না গেলে দারিদ্র্য থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণ কঠিন।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও দিকনির্দেশনা
টেকসইভাবে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
- অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যাতে সমাজের দরিদ্রতম মানুষের কাছে পৌঁছায়, সেজন্য আয় বৈষম্য কমাতে কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা এবং সম্পদ বণ্টনের মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে।
- জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজন কর্মসূচি আরও জোরদার করতে হবে। দুর্যোগ সহনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধ শক্তিশালীকরণ এবং জলবায়ু ঝুঁকি বীমা চালুর মতো উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
- নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে কর্মসূচি: অতিদরিদ্র, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং নগর দরিদ্রদের মতো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে বিশেষায়িত কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
- সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা: দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে দুর্নীতি রোধ করার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
- মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি: চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের তরুণ সমাজকে যুগোপযোগী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যাতে তারা দেশে ও বিদেশে মানসম্মত কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।
উপসংহার
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের পথচলা অত্যন্ত সফল এবং प्रेरणाদায়ক। সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্ভাবনীমূলক কার্যক্রমের সমন্বিত ফল হিসেবে দেশের लाखों মানুষ দারিদ্র্যের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে অভাবনীয় উন্নতির মাধ্যমে মানব উন্নয়ন সূচকেও দেশ বহুদূর এগিয়েছে।
তবে এই সাফল্য আত্মতুষ্টির কারণ নয়। ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র অভিঘাত, নগর দারিদ্র্যের বিস্তার এবং সুশাসনের ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জগুলো এখনও বিদ্যমান। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।
বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে গৃহীত পদক্ষেপ আলোচনা কর।
কোনো পরবর্তী পোস্ট নেই
সম্পর্কিত পোস্ট
একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট
জনসংখ্যা কীভাবে পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করে আলোচনা কর।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ বাড়ে, যার ফলে বায়ু, পানি ও মাটি দূষিত হয়। এই আলোচনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি কীভাবে নগরায়ন, শিল্পায়ন, বনভূমি উজাড় এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দূষণ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার বিশদ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের প্রভাব ও তা নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে।
জীববৈচিত্র সংরক্ষণে বাংলাদেশের ভূমিকা আলোচনা কর।
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, আইন প্রণয়ন, সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক সনদের আলোকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ, যেমন জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, সুন্দরবনসহ বিভিন্ন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি দেশের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং দূষণের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।