ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর।
ভূমিকা
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন একটি যুগান্তকারী অধ্যায়, যা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে যে ঔপনিবেশিক শক্তির সূচনা হয়েছিল, তা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে শেষ হয়। এই দীর্ঘ সময়কালে ব্রিটিশরা নিজেদের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে এমন কিছু পরিবর্তন এনেছিল, যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী ও দ্বিমুখী।
একদিকে, ব্রিটিশ শাসন উপমহাদেশের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন রাজ্যকে একটি এককেন্দ্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে এনেছিল, আধুনিক আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে একটি নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির জন্ম দিয়েছিল। অন্যদিকে, তাদের শাসন ছিল মূলত শোষণভিত্তিক। এর ফলে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, দেশীয় শিল্পের বিনাশ ঘটে এবং ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তীব্রতর হয়। ব্রিটিশ শাসনের এই দ্বৈত প্রকৃতি এবং এর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার বোঝা বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবনের জন্য অপরিহার্য।
রাজনৈতিক প্রভাব
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর এবং মিশ্র। একদিকে এটি আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেছিল, অন্যদিকে এর নীতিগুলো দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে।
১. কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ও রাজনৈতিক ঐক্য
ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ অসংখ্য ছোট-বড় রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ব্রিটিশরা সমগ্র উপমহাদেশকে একটি একক, কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসে। তারা ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (ICS), পুলিশ এবং একটি সুসংগঠিত আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে প্রথমবারের মতো কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত একটি অভিন্ন শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা পূর্বে কোনো শাসকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই রাজনৈতিক ঐক্যই পরবর্তীতে একটি অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণার জন্ম দেয়।
২. নতুন আইন ও বিচার ব্যবস্থা
ব্রিটিশরা উপমহাদেশে একটি আধুনিক এবং বিধিবদ্ধ আইন ব্যবস্থা চালু করে, যা ব্রিটিশ আইনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তারা দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোড (Code of Civil Procedure, Indian Penal Code) তৈরি করে এবং আইনের শাসন (Rule of Law) প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। এই নতুন বিচার ব্যবস্থায় আইনের চোখে সমতার নীতি গ্রহণ করা হয়, যা ঐতিহ্যবাহী বর্ণপ্রথাভিত্তিক বিচার ব্যবস্থার তুলনায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন ছিল। যদিও এর প্রয়োগে প্রায়শই বৈষম্য দেখা যেত, তবুও এই আইনি কাঠামো স্বাধীন ভারতে ও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
৩. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও নতুন শ্রেণির উদ্ভব
ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক প্রয়োজনে একটি ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করতে চেয়েছিল। এই লক্ষ্যে তারা স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে পাশ্চাত্য দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য পড়ানো হতো। এই শিক্ষার ফলে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যারা свобода, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের মতো পাশ্চাত্য ধারণাগুলোর সাথে পরিচিত হয়। এই শিক্ষিত শ্রেণিই পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতারা এই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই উঠে এসেছিলেন।
৪. ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার
ব্রিটিশ শাসকরা তাদের সাম্রাজ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সচেতনভাবে ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ (Divide and Rule) নীতি প্রয়োগ করে। তারা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান বিভেদকে কাজে লাগিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কারে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তাদের পরোক্ষ মদদ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও শত্রুতা বাড়িয়ে তোলে। এই নীতির চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, যা উপমহাদেশে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতার জন্ম দেয়।
৫. জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম
ব্রিটিশ শাসনের শোষণ, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব এবং জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নতুন শ্রেণি ব্রিটিশদের কাছ থেকে শেখা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আদর্শের ভিত্তিতেই নিজেদের অধিকার দাবি করতে শুরু করে। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি संगठিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়। ব্রিটিশ শাসনের নেতিবাচক প্রভাবগুলোই letztendlich ভারতীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং এক দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
ব্রিটিশ শাসনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল অর্থনৈতিক শোষণ, যা ভারতীয় উপমহাদেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ব্রিটিশ অর্থনীতির কাঁচামালের যোগানদাতা ও পণ্যের বাজারে পরিণত করে। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী এবং মূলত ধ্বংসাত্মক।
১. দেশীয় শিল্পের ধ্বংস (De-industrialization)
ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারত, বিশেষ করে বাংলা, বস্ত্রশিল্পে বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত ছিল। মসলিনের মতো সূক্ষ্ম বস্ত্র ইউরোপের বাজারে অত্যন্ত সমাদৃত ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পর ব্রিটিশরা নিজেদের কারখানায় উৎপাদিত বস্ত্রের বাজার নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পকে ধ্বংস করে। তারা অসম শুল্ক নীতি প্রয়োগ করে; ব্রিটেনে ভারতীয় পণ্যের ওপর উচ্চহারে আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়, অন্যদিকে ব্রিটিশ পণ্য প্রায় বিনা শুল্কে ভারতে প্রবেশ করে। এর ফলে ভারতের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প এবং অন্যান্য কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ কারিগর বেকার হয়ে পড়ে। ভারত আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়।
২. কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
ব্রিটিশরা নিজেদের শিল্পকারখানার প্রয়োজনে ভারতে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নীল, তুলা, পাট এবং চায়ের মতো অর্থকরী ফসলের চাষে কৃষকদের বাধ্য করে। একে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ বলা হয়। এর ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় এবং দুর্ভিক্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। ১৭৭০ (বাংলা ১১৭৬) সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত, এর অন্যতম উদাহরণ।
পাশাপাশি, ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন, যার মাধ্যমে জমিদারদের জমির স্থায়ী মালিক করা হয় এবং সরকারের রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এর ফলে জমিদার শ্রেণি ব্রিটিশদের অনুগত এক শক্তিশালী শ্রেণিতে পরিণত হয়, কিন্তু কৃষকদের ওপর শোষণ বহুগুণে বেড়ে যায়। জমিদাররা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য কৃষকদের ওপর উচ্চহারে খাজনা আরোপ করত, যা দিতে না পারলে কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো। এই ব্যবস্থা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দেয়।
৩. সম্পদের নির্গমন (Drain of Wealth)
ব্রিটিশরা systematically ভারত থেকে সম্পদ ব্রিটেনে পাচার করত। দাদাভাই নওরোজি এই প্রক্রিয়াকে "Drain of Wealth" বা সম্পদের নির্গমন বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা উচ্চহারে বেতন ও ভাতা নিতেন, যা ভারতের রাজস্ব থেকে পরিশোধ করা হতো। অবসর গ্রহণের পর এই অর্থ তারা ব্রিটেনে নিয়ে যেতেন। এছাড়া, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনাফা, ব্রিটিশ পুঁজির বিনিয়োগ থেকে লাভ এবং হোম চার্জেস (Home Charges) -এর নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর ভারত থেকে ব্রিটেনে চলে যেত। এই অর্থনৈতিক শোষণ ভারতের পুঁজি গঠনকে বাধাগ্রস্ত করে এবং দেশটিকে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে তোলে।
৪. নতুন যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা
ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক, সামরিক এবং বাণিজ্যিক স্বার্থে ভারতে রেলপথ, টেলিগ্রাফ, ডাক ব্যবস্থা এবং আধুনিক সড়কপথের মতো অবকাঠামো নির্মাণ করে। রেলপথ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত সৈন্য চলাচল নিশ্চিত করা এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাঁচামাল বন্দর পর্যন্ত নিয়ে আসা ও ব্রিটিশ পণ্য সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। যদিও এই অবকাঠামো নির্মাণের পেছনে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক স্বার্থই প্রধান ছিল, এটি পরোক্ষভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে এবং জাতীয়তাবাদের প্রসারে সহায়তা করে।
৫. নতুন অর্থনৈতিক শ্রেণির উদ্ভব
ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক নীতির ফলে ভারতীয় সমাজে নতুন কিছু শ্রেণির উদ্ভব হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে একটি অনুগত জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, ব্রিটিশদের দালাল, বেনিয়া ও মহাজন হিসেবে কাজ করে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণিরও জন্ম হয়। এই নব্য ধনী শ্রেণি প্রায়শই গ্রামীণ কৃষক ও কারিগরদের শোষণ করে সম্পদশালী হতো এবং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার সমর্থক হিসেবে কাজ করত।
সামাজিক প্রভাব
ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক কাঠামো, প্রথা এবং জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই পরিবর্তনগুলো কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তা ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত।
১. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন
ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক কাজের জন্য ইংরেজি জানা কর্মচারী তৈরির উদ্দেশ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন করে। ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনামলে মেকলের সুপারিশে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শিক্ষার ফলে ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যের সংস্পর্শে আসে। এটি তাদের মধ্যে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং আধুনিক চিন্তাধারার জন্ম দেয়, যা পরবর্তীকালে সমাজ সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. সামাজিক কুসংস্কার বিলোপ ও সংস্কার আন্দোলন
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে এবং রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ভারতীয় সমাজ সংস্কারকদের উদ্যোগে উনিশ শতকে একাধিক সামাজিক সংস্কার সাধিত হয়। ব্রিটিশ সরকার এসব সংস্কারককে সমর্থন জানায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ (১৮২৯): লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় আইন করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন।
- বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬): ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় লর্ড ডালহৌসির সময়ে বিধবা বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- নরবলি ও শিশুহত্যা রোধ: ব্রিটিশ সরকার আইন প্রয়োগ করে নরবলি এবং কন্যাসন্তান হত্যার মতো নৃশংস প্রথাগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করে।
এই সংস্কারগুলো ভারতীয় সমাজে, বিশেষ করে হিন্দু সমাজে, একটি ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।
৩. নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ
ব্রিটিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থা, নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতে একটি নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়। এই শ্রেণিতে মূলত আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সরকারি চাকুরিজীবীরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই শ্রেণিটি ছিল আধুনিকমনস্ক এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তারাই উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার এবং বিশ শতকের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই শ্রেণিটি শহরকেন্দ্রিক ছিল এবং গ্রামীণ সমাজ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ছিল।
৪. নগরজীবনের প্রসার
ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজের মতো বন্দর শহরগুলো প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। রেলপথ ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে গ্রাম থেকে বহু মানুষ জীবিকার সন্ধানে শহরে আসতে শুরু করে। এর ফলে নগরায়ণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং একটি নতুন শহুরে সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার বিকাশ ঘটে। এই শহরগুলোই আধুনিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়।
সাংস্কৃতিক প্রভাব
ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গভীর এবং দ্বিমুখী পরিবর্তন সাধিত হয়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হলেও এটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
১. ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব
ব্রিটিশরা প্রশাসনিক ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার ব্যাপক প্রচলন ঘটায়। এর ফলে ইংরেজি ভাষা উপমহাদেশের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে এবং ভারতীয় সাহিত্য ও চিন্তাধারায় এর গভীর প্রভাব পড়ে। শেক্সপীয়ার, মিলটন, বায়রনের মতো সাহিত্যিকদের রচনা ভারতীয় লেখকদের অনুপ্রাণিত করে। ভারতীয় লেখকরাও ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা শুরু করেন, যা বিশ্ব দরবারে ভারতীয় সাহিত্যকে পরিচিতি দেয়। তবে এর একটি নেতিবাচক দিক হলো, এর ফলে স্থানীয় ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পায়।
২. বাংলার নবজাগরণ (Bengal Renaissance)
উনিশ শতকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও শিক্ষার সংস্পর্শে এসে বাংলায় এক বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে, যা বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত। রাজা রামমোহন রায়কে এই নবজাগরণের পথিকৃৎ বলা হয়। এই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মনিষীরা সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ও সমাজ সংস্কারে যুগান্তকারী অবদান রাখেন। তাঁদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। এই নবজাগরণ ছিল মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে এর প্রভাব সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
৩. মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও সংবাদপত্রের বিকাশ
ব্রিটিশ আমলে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে, যা জ্ঞানচর্চা ও ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব নিয়ে আসে। এর ফলে বই, পত্রিকা ও সংবাদপত্র ছাপানো সহজ হয়ে যায়। জেমস ऑगस्टাস হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ থেকে শুরু করে ‘সমাচার দর্পণ’, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ এবং পরবর্তীতে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র মতো অসংখ্য সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এই সংবাদপত্রগুলো জনমত গঠন, ব্রিটিশ সরকারের নীতির সমালোচনা এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. স্থাপত্য ও শিল্পকলায় পরিবর্তন
ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব স্থাপত্যরীতি উপমহাদেশে নিয়ে আসে, যা ‘ইন্দো-সারাসেনিক’ শৈলী নামে পরিচিত। এই রীতিতে ব্রিটিশ, মুঘল এবং ভারতীয় স্থাপত্যের এক মিশ্রণ দেখা যায়। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস এবং ঢাকার কার্জন হল এর उत्कृष्ट উদাহরণ। চিত্রকলা এবং অন্যান্য শিল্পেও পাশ্চাত্য রীতির প্রভাব পড়ে, যা传统 ভারতীয় শিল্পকলাকে নতুনভাবে প্রভাবিত করে।
উপসংহার
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ছিল বহুমাত্রিক, জটিল এবং পরস্পরবিরোধী। এটি একদিকে যেমন আধুনিক প্রশাসন, আইন ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিকতার দ্বার উন্মোচন করেছিল, তেমনই এর অর্থনৈতিক শোষণ, সম্পদের নির্গমন এবং 'ভাগ কর ও শাসন কর' নীতির মাধ্যমে উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসন উপমহাদেশকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করলেও দেশভাগের মাধ্যমে এমন এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে গেছে, যা আজও এই অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। তাদের প্রবর্তিত শিক্ষা একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করেছিল, যারা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রেলপথের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক শোষণকে সহজতর করা। ফলস্বরূপ, ব্রিটিশরা যখন উপমহাদেশ ছেড়ে যায়, তখন তারা রেখে যায় একটি দরিদ্র, বিভক্ত এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত অঞ্চল। তাই ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকারকে কেবল সাদা বা কালোতে বিচার করা সম্ভব নয়; এটি ছিল এমন এক অধ্যায় যা একই সাথে গঠন এবং ধ্বংসের সাক্ষী। এই জটিল উত্তরাধিকার আজও বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে রূপদান করে চলেছে।
সম্পর্কিত পোস্ট
একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট
সাঁওতাল নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জীবনধারা আলোচনা কর।
বাংলাদেশের সাঁওতাল নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জীবনধারা, তাদের অনন্য ইতিহাস, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে একটি বিশদ আলোচনা। এই আলোচনায় তাদের সামাজিক প্রথা, উৎসব, এবং আধুনিকতার সাথে ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার সমন্বয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর।
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবার কীভাবে শিশুর ব্যক্তিত্ব, ভাষা, মূল্যবোধ ও আচরণ গঠন করে এবং ধর্ম কীভাবে নৈতিকতা, সামাজিক সংহতি ও জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণে প্রভাব ফেলে, তার বিশদ আলোচনা। এই বিষয়বস্তুটি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।