Skip to main content

সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সমাজের সদস্য হিসেবে গড়ে ওঠে এবং নিজ সংস্কৃতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আচরণ আয়ত্ত করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষ তার জৈবিক সত্তা থেকে সামাজিক সত্তায় রূপান্তরিত হয়। সামাজিকীকরণের अनेक বাহন বা মাধ্যম রয়েছে, যেমন— পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, খেলার সাথী ইত্যাদি। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রাথমিক মাধ্যম হলো পরিবারধর্ম। পরিবার শিশুর প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যেখানে তার ব্যক্তিত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়। অন্যদিকে, ধর্ম মানুষের নৈতিকতা, আদর্শ ও সামাজিক সংহতি গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এখানকার সমাজ ও সংস্কৃতি মূলত পারিবারিক বন্ধন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত।

সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা

পরিবারকে সামাজিকীকরণের প্রাথমিক ও সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিশু জন্মের পর থেকে পরিবারের সদস্যদের সংস্পর্শে আসে এবং তাদের কাছ থেকেই জগৎ সম্পর্কে প্রথম ধারণা লাভ করে। পরিবারের ভূমিকাগুলো নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. ভাষা ও ভাবের আদান-প্রদান শিক্ষা

শিশু তার পরিবার থেকেই প্রথম ভাষা শেখে। পরিবারের সদস্যরা কীভাবে কথা বলে, কোন শব্দ ব্যবহার করে, এবং কীভাবে আবেগ প্রকাশ করে, শিশু তা অনুকরণ করার চেষ্টা করে। ভাষার মাধ্যমে শিশু কেবল যোগাযোগই শেখে না, বরং সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানও আয়ত্ত করে। ভাষার ওপর দখলই তাকে পরবর্তী জীবনে সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করে।

২. মৌলিক নিয়মকানুন ও মূল্যবোধ গঠন

প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন, আদর্শ ও মূল্যবোধ থাকে। শিশু ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে শেখে কোনটি ভালো এবং কোনটি মন্দ, কী করা উচিত এবং কী অনুচিত। সততা, বড়দের সম্মান করা, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ, সহযোগিতা ও সহানুভূতির মতো মৌলিক মানবিক গুণাবলি শিশু পরিবারেই প্রথম শেখে। এই শিক্ষা তার ভবিষ্যৎ জীবনের নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে।

৩. সামাজিক পরিচয় ও মর্যাদা প্রদান

পরিবারই একজন ব্যক্তিকে তার প্রাথমিক সামাজিক পরিচয় প্রদান করে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং সামাজিক শ্রেণির মতো পরিচয়গুলো ব্যক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবার থেকে লাভ করে। এই পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করেই সমাজ তাকে একটি নির্দিষ্ট মর্যাদা প্রদান করে। পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক সম্পর্ককে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে।

৪. লিঙ্গীয় ভূমিকা শিক্ষা

পরিবার থেকেই শিশু নারী ও পুরুষের সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোতে সাধারণত লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন দেখা যায়। শিশুরা তাদের বাবা-মা ও অন্যান্য সদস্যদের দেখে শেখে সমাজে নারী ও পুরুষের কাছে কী ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করা হয়। যদিও আধুনিকায়নের ফলে এই ধারণায় পরিবর্তন আসছে, তবুও পরিবার এখনও লিঙ্গীয় ভূমিকা নির্ধারণে একটি শক্তিশালী মাধ্যম।

৫. আবেগীয় বিকাশ ও নিরাপত্তা প্রদান

পরিবার শিশুর মানসিক ও আবেগীয় বিকাশের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া স্নেহ, ভালোবাসা ও যত্ন শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। পারিবারিক সম্পর্কের গুণগত মান শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। একটি সুস্থ ও সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ শিশুর ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশে সহায়তা করে, অন্যদিকে পারিবারিক কলহ বা অস্থিতিশীলতা তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

সামাজিকীকরণে ধর্মের ভূমিকা

পরিবারের পাশাপাশি ধর্মও সামাজিকীকরণের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রাচীন মাধ্যম। ধর্ম ব্যক্তির বিশ্বাস, জীবনদর্শন, নৈতিকতা ও সামাজিক আচরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ সমাজে এর ভূমিকা আরও বেশি প্রকট।

১. নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি

ধর্ম মানুষকে একটি নৈতিক কাঠামো প্রদান করে। পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিষয়ে ধর্মীয় অনুশাসন ব্যক্তিকে সঠিক পথে চলতে উৎসাহিত করে। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে সততা, ক্ষমা, দয়া, পরোপকার ও সহানুভূতির মতো মানবিক গুণাবলি অর্জনে प्रेरित করে। এই নৈতিক শিক্ষা ব্যক্তিকে সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলতে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে।

২. সামাজিক সংহতি ও ঐক্য স্থাপন

ধর্ম একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে একটি শক্তিশালী ঐক্য ও সংহতির বোধ তৈরি করে। ধর্মীয় উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান ও উপাসনালয়কেন্দ্রিক কার্যক্রম людейকে একত্রিত করে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই ধর্মীয় বন্ধন সামাজিক বিভেদ কমিয়ে আনতে এবং একটি সুসংহত সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ

ধর্ম একটি অনানুষ্ঠানিক কিন্তু শক্তিশালী সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ধর্মীয় অনুশাসন ও পারলৌকিক শাস্তির ভয় মানুষকে সমাজের প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি ও আইন মেনে চলতে বাধ্য করে। অনেক ক্ষেত্রেই আইন যা করতে পারে না, ধর্মীয় বিশ্বাস তা সহজেই করতে পারে। এটি মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

৪. জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য প্রদান

ধর্ম মানুষের জীবনকে একটি বৃহত্তর অর্থ ও উদ্দেশ্য প্রদান করে। জন্ম, মৃত্যু, দুঃখ-কষ্ট এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে মানুষ মানসিক শান্তি লাভ করে। ধর্ম জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে সাহায্য করে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষকে ধৈর্য ধারণ ও সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার শক্তি জোগায়।

৫. সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সঞ্চালন

ধর্ম একটি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব, শিল্পকলা, সংগীত এবং সাহিত্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি সমাজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বহন করে। শিশুরা ধর্মীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়, যা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সমৃদ্ধ করে।

উপসংহার

সামগ্রিক আলোচনা থেকে এটি स्पष्ट যে, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবার ও ধর্ম দুটি মৌলিক এবং অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। পরিবার শিশুর ব্যক্তিত্বের ভিত্তি স্থাপন করে এবং তাকে সমাজের প্রাথমিক নিয়মকানুন ও মূল্যবোধ শেখায়। অন্যদিকে, ধর্ম ব্যক্তিকে নৈতিক ও মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে এবং সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। যদিও বিশ্বায়ন, নগরায়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবে সামাজিকীকরণের নতুন নতুন মাধ্যম, যেমন— গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান— শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তবুও ব্যক্তির চরিত্র, বিশ্বাস ও সামাজিক আচরণ গঠনে পরিবার ও ধর্মের foundational ভূমিকা আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্যসমূহ সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনায় জনসংখ্যার আকার, ঘনত্ব, বয়স কাঠামো, লিঙ্গ অনুপাত, নগরায়ন, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য সূচক, কর্মসংস্থান, এবং পারিবারিক কাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।

পড়ুন

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন একাধারে গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। এই সময়কালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সাধিত হয়, যা এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। ব্রিটিশরা केंद্রীভূত প্রশাসন, নতুন আইন ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন করলেও তাদের অর্থনৈতিক শোষণ, 'ভাগ কর ও শাসন কর' নীতি এবং দেশীয় শিল্পের ধ্বংস এই অঞ্চলের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। এই শাসনের ফলে একটি নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়, যারা পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার অত্যন্ত জটিল এবং এর প্রভাব আজও উপমহাদেশে দৃশ্যমান।

পড়ুন