স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভূমিকা
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ দেশটির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়। সেই সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট এই শ্রেণির যে ভিত্তি ছিল, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তা নতুন মাত্রা ও আঙ্গিক লাভ করে। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, বৈদেশিক আয় এবং নগরায়ণের মতো বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাবে এই শ্রেণি ক্রমাগত壮িশালী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থানকারী এই শ্রেণিটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মানদণ্ডে সংজ্ঞায়িত নয়, বরং তাদের জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ, আকাঙ্ক্ষা এবং সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেও পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী দশকগুলোতে রাষ্ট্রের নীতি, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বিশ্বায়নের প্রভাব এই শ্রেণির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই শ্রেণির ভূমিকা অপরিসীম এবং এর বিকাশমান ধারা দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে একটি অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের কারণ
১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ও সম্প্রসারণের পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান। এই কারণগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত এবং সম্মিলিতভাবে এই সামাজিক স্তরটির ভিত্তি মজবুত করেছে।
১. শিক্ষার প্রসার
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নতুন নতুন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে গ্রামীণ ও শহর উভয় এলাকার মানুষের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সরকারি ও বেসরকারি খাতে চাকরির প্রধান উৎস হয়ে ওঠে, যা একটি স্থিতিশীল আয়ের পথ খুলে দেয় এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হতে সহায়তা করে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রসার পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে এবং সামাজিক গতিশীলতায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
২. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কাঠামোগত পরিবর্তন
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্প ও সেবাখাতভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি এবং ব্যাংকিং খাতের বিস্তার বহুসংখ্যক মানুষের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করেছে, যা তাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হতে সাহায্য করেছে।
৩. নগরায়ণ
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের খোঁজে বিপুল সংখ্যক মানুষ গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ায় সেখানে নতুন পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী শ্রেণির উদ্ভব হয়। এই শহুরে জীবনধারা ও পেশাগত সুযোগ মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকার ও প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
৪. বৈদেশিক রেমিট্যান্সের প্রভাব
বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় কর্মরত আছেন। তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এই রেমিট্যান্স গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি অনেক পরিবারকে দারিদ্র্যসীমা থেকে তুলে এনে মধ্যবিত্তের কাতারে সামিল করেছে। এর মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান, ভোগ প্রবণতা এবং সামাজিক মর্যাদার উন্নতি ঘটেছে।
৫. বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে আশির দশক থেকে, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে বহু মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, ছোট ব্যবসা ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে। এর ফলে তাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরিবারগুলো ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশ করেছে।
৬. সরকারি চাকরির বিস্তার ও বেতন কাঠামোর উন্নতি
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো সম্প্রসারণের ফলে সরকারি চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পায়। সময়ের সাথে সাথে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্থিতিশীলতা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এক কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। এই শ্রেণির বিকাশ দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিকে যেমন গতিশীল করেছে, তেমনই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তনেও প্রভাব ফেলেছে।
১. অর্থনৈতিক ভূমিকা
-
ভোগ বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণ: মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের ভোগ করার ক্ষমতাও বেড়েছে। এর ফলে দেশে ভোগ্যপণ্য, ইলেকট্রনিক্স, আবাসন এবং সেবাখাতের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বর্ধিত চাহিদা অভ্যন্তরীণ বাজারকে সম্প্রসারিত করেছে এবং নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি করেছে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
-
সঞ্চয় ও বিনিয়োগ: মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় করে এবং বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে। ব্যাংকিং খাতে আমানত বৃদ্ধি, সঞ্চয়পত্র ক্রয় এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা দেশের পুঁজি গঠনে অবদান রাখে। এই সঞ্চয় ও বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
-
উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশ: সনাতনী চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের পাশাপাশি একটি নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণিরও বিকাশ ঘটেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসারে এই শ্রেণির অবদান উল্লেখযোগ্য। তথ্যপ্রযুক্তি, ই-কমার্স, এবং বিভিন্ন সেবাখাতে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এবং অর্থনীতিতে উদ্ভাবনী মাত্রা যোগ করছে।
২. সামাজিক ভূমিকা
-
শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা: মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সন্তানদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাদের প্রচেষ্টা দেশের সামগ্রিক শিক্ষার হার এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
-
আধুনিক ও প্রগতিশীল মূল্যবোধের প্রসার: এই শ্রেণি সাধারণত আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার ধারক। তারা নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, এবং সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন ভূমিকা পালন করে। তাদের জীবনযাত্রা ও মূল্যবোধ সমাজের অন্যান্য অংশকেও প্রভাবিত করে।
-
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা: সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটকসহ বিভিন্ন সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও ভোক্তা হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সজীব ও গতিশীল রাখে।
-
স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে সচেতনতা: স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, উন্নত খাদ্যাভ্যাস এবং আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি এই শ্রেণির আগ্রহ বেশি। তাদের সচেতনতা দেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সূচকগুলোর উন্নতিতে পরোক্ষভাবে অবদান রাখে।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক ভূমিকা
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবেই এই শ্রেণি সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত।
১. জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব
ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ও প্রসারে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, ও পেশাজীবীরাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। '৫২-র ভাষা আন্দোলন, '৬৬-র ছয় দফা, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই শ্রেণির অংশগ্রহণ ছিল সর্বাধিক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই শ্রেণি সর্বদা সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে।
২. গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনে ভূমিকা
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র, শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, এবং সংস্কৃতিকর্মীরা সম্মিলিতভাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছেন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাদের লেখনী, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং রাজপথে সক্রিয় অংশগ্রহণ রাজনৈতিক পরিবর্তনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের দাবিদার
মধ্যবিত্ত শ্রেণি সাধারণত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পক্ষে অবস্থান করে। তারা একটি কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রত্যাশা করে। সুশাসন, আইনের শাসন, এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই শ্রেণি প্রায়শই সোচ্চার হয়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সরব উপস্থিতি সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডের উপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে।
৪. রাজনৈতিক মতাদর্শের ধারক ও বাহক
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মূল ভিত্তি এবং সমর্থক গোষ্ঠী মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই আগত। এই শ্রেণি রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শকে ধারণ করে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। নির্বাচনের সময় তাদের ভোট এবং রাজনৈতিক মতামত নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। তবে, সময়ের সাথে সাথে এই শ্রেণির একটি অংশের মধ্যে রাজনীতি-বিমুখতা এবং নিষ্ক্রিয়তাও লক্ষ্য করা যায়, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
বর্তমান বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকট ও চ্যালেঞ্জ
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও বর্তমান বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বহুমুখী সংকট ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জগুলো তাদের জীবনযাত্রার মান, স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করছে।
১. ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং যাতায়াত খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়েছে। তাদের সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের সাথে ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। মজুরি বা বেতন যে হারে বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতির হার তার চেয়ে বেশি হওয়ায় তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে, যা সঞ্চয়কে সংকুচিত করছে এবং জীবনযাত্রার মান ধরে রাখাকে কঠিন করে তুলেছে।
২. আয়ের নিরাপত্তাহীনতা ও কর্মসংস্থানের সংকট
সরকারি চাকরির বাইরে বেসরকারি খাতে চাকরির নিরাপত্তা তুলনামূলকভাবে কম। অর্থনৈতিক মন্দা, অটোমেশন এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে অনেকেই চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন। অন্যদিকে, শিক্ষিত তরুণদের জন্য মানসম্মত চাকরির সুযোগ সীমিত। ফলে বেকারত্ব বা অর্ধ-বেকারত্ব এই শ্রেণির একটি বড় অংশের জন্য কঠিন বাস্তবতা।
৩. গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব
সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের মানের অবনতির কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বেসরকারি খাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এটি তাদের উপর একটি বড় অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করে। সন্তানদের জন্য ভালো শিক্ষা এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে গিয়ে অনেক পরিবারকে হিমশিম খেতে হয় এবং অনেক সময় ঋণের জালে আবদ্ধ হতে হয়।
৪. নগরায়ণের সমস্যা
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট যানজট, আবাসন সংকট, দূষণ এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব মধ্যবিত্তের শহুরে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকা তাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৫. সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়
সমাজের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মধ্যবিত্তের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। মেধা ও যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় অনেকেই দেশত্যাগে আগ্রহী হন, যা 'ব্রেইন ড্রেইন' বা মেধা পাচারের মতো সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। তারা প্রায়শই রাজনৈতিক মেরুকরণের শিকার হয় এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে উপেক্ষিত থাকে।
উপসংহার
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ নিঃসন্দেহে দেশটির অন্যতম সফল একটি সামাজিক রূপান্তরের গল্প। শিক্ষা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স এবং নগরায়ণের ডানায় ভর করে এই শ্রেণিটি ক্রমাগত壮িশালী হয়েছে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কেন্দ্রীয় নিয়ামক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা যেমন আধুনিকতার অগ্রদূত, তেমনই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রধান রক্ষক।
তবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিটি মুদ্রাস্ফীতি, আয়ের নিরাপত্তাহীনতা, এবং গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদার সংকটে জর্জরিত। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা না গেলে মধ্যবিত্তের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে। সুতরাং, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের উচিত মধ্যবিত্তের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, কারণ একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণিই একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের মূল ভিত্তি।
সম্পর্কিত পোস্ট
একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট
বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্যসমূহ সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনায় জনসংখ্যার আকার, ঘনত্ব, বয়স কাঠামো, লিঙ্গ অনুপাত, নগরায়ন, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য সূচক, কর্মসংস্থান, এবং পারিবারিক কাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব আলোচনা কর।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন একাধারে গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। এই সময়কালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সাধিত হয়, যা এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। ব্রিটিশরা केंद্রীভূত প্রশাসন, নতুন আইন ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন করলেও তাদের অর্থনৈতিক শোষণ, 'ভাগ কর ও শাসন কর' নীতি এবং দেশীয় শিল্পের ধ্বংস এই অঞ্চলের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। এই শাসনের ফলে একটি নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়, যারা পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার অত্যন্ত জটিল এবং এর প্রভাব আজও উপমহাদেশে দৃশ্যমান।