Skip to main content

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কারণ, প্রকৃতি ও গুরুত্ব আলোচনা কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, যা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মহাবিদ্রোহ নামেও পরিচিত, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় এবং রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র প্রতিরোধ। যদিও এই বিদ্রোহ সিপাহীদের দ্বারা শুরু হয়েছিল, তবে খুব দ্রুত এটি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে কৃষক, কারিগর, জমিদার ও বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের শাসকেরাও অংশ নেন।

ব্রিটিশ শাসনের একশ বছর পূর্তিতে (১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর) সংঘটিত এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এর পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং সামরিক ক্ষোভ। এই বিদ্রোহ সফল না হলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী, যা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং একটি নতুন যুগের সূচনা করে। তাই, ১৮৫৭ সালের এই মহাবিদ্রোহের কারণ, প্রকৃতি ও গুরুত্ব অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি।

সিপাহী বিদ্রোহের কারণসমূহ

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এর পেছনে প্রায় এক শতাব্দীর ব্রিটিশ শোষণ, নিপীড়ন এবং ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতির প্রভাব ছিল। এই কারণগুলোকে কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।

১. রাজনৈতিক কারণ

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী নীতি ভারতীয় শাসকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি করেছিল, যা বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ।

  • স্বত্ববিলোপ নীতি: লর্ড ডালহৌসি প্রবর্তিত 'স্বত্ববিলোপ নীতি' (Doctrine of Lapse) ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত। এই নীতি অনুসারে, কোনো দেশীয় রাজ্যের রাজার পুত্র সন্তান না থাকলে বা দত্তক পুত্র নিলে, সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। এই নীতির মাধ্যমে সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুরসহ একাধিক রাজ্য ব্রিটিশরা দখল করে নেয়। এটি ভারতীয় শাসকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল।

  • পদ ও उपाधि বিলোপ: ব্রিটিশরা অনেক দেশীয় শাসকের পদ, উপাধি ও ভাতা বাতিল করে দেয়। যেমন, কর্ণাটকের নবাবের পদ বিলুপ্ত করা হয় এবং পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র নানা সাহেবের পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি অভিজাত ও রাজপরিবারগুলোকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে।

  • অযোধ্যা দখল: ১৮৫৬ সালে কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা রাজ্য দখল করা ব্রিটিশদের একটি বড় রাজনৈতিক ভুল ছিল। অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে কলকাতায় নির্বাসনে পাঠানো হয়, যা অযোধ্যার জনগণ ও সৈন্যদের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে থাকা বিপুল সংখ্যক সিপাহী ছিল অযোধ্যার অধিবাসী।

  • মুঘল সম্রাটের অপমান: ব্রিটিশরা মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে অসম্মান করে এবং ঘোষণা করে যে তার পরে আর কেউ সম্রাট উপাধি ব্যবহার করতে পারবে না। এটি ভারতের মুসলিমদের অনুভূতিতে মারাত্মকভাবে আঘাত হানে।

২. অর্থনৈতিক কারণ

ব্রিটিশদের শোষণমূলক অর্থনৈতিক নীতি ভারতের ঐতিহ্যবাহী অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং সকল শ্রেণীর মানুষকে চরম দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

  • ভূমি রাজস্ব নীতি: ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রায়তওয়ারি ও মহলওয়ারি ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকদের ওপর উচ্চ হারে কর আরোপ করে। কর আদায়ে চরম নির্যাতন চালানো হতো, যার ফলে কৃষকরা জমি হারিয়ে ভূমিহীন শ্রমিকে পরিণত হয়।

  • দেশীয় শিল্পের ধ্বংস: শিল্প বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি সস্তা পণ্যে ভারতের বাজার ছেয়ে যায়। এর ফলে ভারতের বিখ্যাত বস্ত্রশিল্পসহ অন্যান্য কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ কারিগর ও শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে, যা অর্থনৈতিক অসন্তোষকে তীব্র করে তোলে।

  • সম্পদের নির্গমন: ব্রিটিশরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ভারত থেকে ইংল্যান্ডে পাচার করে, যা "Drain of Wealth" নামে পরিচিত। এর ফলে ভারত ক্রমশ দরিদ্র হতে থাকে।

৩. সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ

ব্রিটিশদের গৃহীত কিছু সামাজিক সংস্কার এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ ভারতীয় সমাজের রক্ষণশীল অংশে গভীর উদ্বেগ ও সন্দেহের জন্ম দেয়।

  • সামাজিক সংস্কার: সতীদাহ প্রথা বাতিল, বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন এবং নারী শিক্ষার প্রসারের মতো পদক্ষেপগুলো ভারতীয়দের একাংশ তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে।

  • খ্রিস্টধর্ম প্রচার: খ্রিস্টান মিশনারিরা স্কুল, হাসপাতাল ও দুর্ভিক্ষের সময়ে সেবার আড়ালে ব্যাপকভাবে ধর্ম প্রচার করত। তারা হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করত, যা সাধারণ মানুষের মনে ধর্মান্তরের ভয় ঢুকিয়ে দেয়।

  • জাতিগত বৈষম্য: ব্রিটিশরা ভারতীয়দের সাথে অত্যন্ত বৈষম্যমূলক ও অপমানজনক আচরণ করত। ভারতীয়দের "কালো" বা "বর্বর" বলে অবজ্ঞা করা হতো এবং তাদের জন্য ক্লাব, পার্ক বা রেলের কামরা সংরক্ষিত থাকত। এই বর্ণবিদ্বেষী আচরণ ভারতীয়দের আত্মসম্মানে আঘাত করে।

৪. সামরিক কারণ

বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল সিপাহীদের হাত ধরে, কারণ তারাই ছিল ব্রিটিশ বৈষম্যের প্রত্যক্ষ শিকার।

  • বেতন ও পদোন্নতিতে বৈষম্য: ভারতীয় সিপাহীদের বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ব্রিটিশ সৈন্যদের তুলনায় অনেক কম ছিল। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়রা কখনো উচ্চ পদে পদোন্নতি পেত না।

  • ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত: সিপাহীদের কপালে তিলক পরা, দাড়ি রাখা বা পাগড়ি পরার মতো ধর্মীয় আচারে হস্তক্ষেপ করা হতো। ১৮৫৬ সালের 'জেনারেল সার্ভিস এনলিস্টমেন্ট অ্যাক্ট' অনুসারে, সিপাহীদের প্রয়োজনে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে যুদ্ধ করতে পাঠানো হতো, যা হিন্দু সিপাহীদের জন্য ধর্মনাশের সামিল ছিল।

  • প্রত্যক্ষ কারণ (এনফিল্ড রাইফেল): বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেলের নতুন কার্তুজের প্রবর্তন। গুজব রটে যায় যে এই কার্তুজের আবরণটি গরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি, যা দাঁত দিয়ে কেটে রাইফেলে ভরতে হতো। এটি হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সিপাহীদের ধর্মীয় বিশ্বাসে চরম আঘাত হানে এবং বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

বিদ্রোহের প্রকৃতি

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। এটি কি নিছক সিপাহীদের অসন্তোষের প্রকাশ ছিল, নাকি এটি ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম? এই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত নিচে তুলে ধরা হলো।

১. সিপাহী বিদ্রোহ

অনেক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িক ভারতীয় যেমন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ আহমেদ খান এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র এই ঘটনাকে শুধুমাত্র একটি "সিপাহী বিদ্রোহ" হিসেবে দেখেছেন। তাদের যুক্তিগুলো হলো:

  • সূচনা ও কেন্দ্রবিন্দু: বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল সিপাহীদের দ্বারা এবং এর মূল চালিকাশক্তিও ছিল তারাই।
  • সীমিত বিস্তার: এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েনি। দক্ষিণ ভারত, পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং বাংলার অধিকাংশ অঞ্চল শান্ত ছিল।
  • শিক্ষিত শ্রেণীর عدم অংশগ্রহণ: ভারতের উদীয়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি, বরং তারা এটিকে প্রগতির অন্তরায় হিসেবে দেখেছিল।
  • সাধারণ মানুষের নিষ্ক্রিয়তা: অনেক ঐতিহাসিকের মতে, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এই বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিল।

২. জাতীয় বিদ্রোহ বা গণবিদ্রোহ

বিপরীতে, বেঞ্জামিন ডিজরেলি, কার্ল মার্কস এবং অনেক জাতীয়তাবাদী ভারতীয় ঐতিহাসিক যেমন ভি. ডি. সাভারকার, শশীভূষণ চৌধুরী প্রমুখ এই বিদ্রোহকে একটি "জাতীয় বিদ্রোহ" বা "গণবিদ্রোহ" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের যুক্তিসমূহ হলো:

  • ব্যাপক অংশগ্রহণ: সিপাহীরা বিদ্রোহ শুরু করলেও দ্রুত এতে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ, কৃষক, কারিগর এবং সামন্ত প্রভুরা যোগ দেয়। অযোধ্যা, বিহার এবং উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের মতো অঞ্চলগুলোতে এটি গণবিদ্রোহের রূপ নেয়।
  • হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: এই বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য দেখা যায়। তারা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে।
  • বিদেশী শাসন অবসানের লক্ষ্য: বিদ্রোহীদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো এবং ভারতকে বিদেশী আধিপত্য থেকে মুক্ত করা।
  • জাতীয়তাবাদের প্রথম স্ফুরণ: যদিও আধুনিক জাতীয়তাবাদের ধারণা তখন স্পষ্ট ছিল না, এই বিদ্রোহই প্রথম সর্বভারতীয় ব্রিটিশ-বিরোধী চেতনার জন্ম দেয়।

৩. ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ

বিনায়ক দামোদর সাভারকার তার "The Indian War of Independence" গ্রন্থে এই বিদ্রোহকে "ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ" বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, স্বধর্ম ও স্বরাজ রক্ষার জন্য হিন্দু-মুসলিমের এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার প্রথম সংগঠিত প্রচেষ্টা। যদিও ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিকরা এই মতের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, এটিকে 'প্রথম', 'জাতীয়' বা 'স্বাধীনতা যুদ্ধ' বলা যায় না, কারণ এর কোনো সুসংগঠিত পরিকল্পনা বা সর্বভারতীয় চরিত্র ছিল না।

সার্বিকভাবে বলা যায়, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সিপাহীদের মাধ্যমে শুরু হলেও এটি নিছক সামরিক বিদ্রোহ ছিল না। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের এক ব্যাপক বহিঃপ্রকাশ, যাতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিল। তাই একে একটি অসংগঠিত গণবিদ্রোহ বা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রথম পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ব্রিটিশদের দ্বারা কঠোরভাবে দমন করা হলেও ভারতীয় ইতিহাসে এর গুরুত্ব ও ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

১. কোম্পানি শাসনের অবসান

বিদ্রোহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যক্ষ ফলাফল হলো ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮৫৮ সালের "ভারত শাসন আইন" (Government of India Act 1858) পাস করে ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ রাজ বা মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেয়।

২. ব্রিটিশ রাজের প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা

মহারানী ভিক্টোরিয়া "ভারত সম্রাজ্ঞী" উপাধি ধারণ করেন এবং তার প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর-জেনারেলকে "ভাইসরয়" পদে উন্নীত করা হয়। লর্ড ক্যানিং ছিলেন ভারতের প্রথম ভাইসরয়। এর মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ রাজের প্রত্যক্ষ শাসন শুরু হয়।

৩. মহারানীর ঘোষণাপত্র

১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর মহারানী ভিক্টোরিয়া একটি ঘোষণাপত্র জারি করেন, যেখানে ভারতীয়দের জন্য কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়:

  • স্বত্ববিলোপ নীতির অবসান: ব্রিটিশ সরকার ভারতে আর রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করবে না এবং দেশীয় রাজাদের দত্তক গ্রহণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
  • ধর্মীয় সহিষ্ণুতা: ভারতীয়দের ধর্মীয় বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
  • চাকরিতে সমানাধিকার: যোগ্যতা অনুযায়ী ভারতীয়দের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আশ্বাস দেওয়া হয়, যদিও বাস্তবে তা খুব কমই পালিত হতো।

৪. সামরিক পুনর্গঠন

বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা সেনাবাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে।

  • ভারতীয় সিপাহীর সংখ্যা কমানো হয় এবং ব্রিটিশ সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়।
  • গোলন্দাজ বাহিনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো পুরোপুরি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
  • "ভাগ করো ও শাসন করো" (Divide and Rule) নীতির অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীতে জাতি, ধর্ম ও অঞ্চলের ভিত্তিতে রেজিমেন্ট গঠন করা হয়, যাতে সিপাহীদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠতে না পারে।

৫. জাতীয়তাবাদের উন্মেষ

এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম দেয়। নানা সাহেব, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া টোপি এবং মঙ্গল পাণ্ডের মতো নেতাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্মের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এই বিদ্রোহই ছিল আধুনিক ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি।

৬. মোগল সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন

বিদ্রোহ দমনের পর শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে বন্দী করে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হয়, যেখানে তার মৃত্যু হয়। এর মাধ্যমে ভারতে প্রায় ৩৩২ বছরের মোগল শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে।

উপসংহার

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের এক শতাব্দীর ক্ষোভ, হতাশা ও প্রতিরোধের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। যদিও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, সমন্বয়ের অভাব এবং উন্নত অস্ত্রের কাছে এই বিদ্রোহ পরাজিত হয়েছিল, এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য অপরিসীম। এই বিদ্রোহ ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ রাজের প্রত্যক্ষ শাসনের সূচনা করে এবং ভারতীয়দের শাসনব্যবস্থায় কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, এই মহাবিদ্রোহের আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাথা পরাধীন ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবোধ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে, যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথকে প্রশস্ত করেছিল। তাই, একে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গৌরবময় ও pivotal অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির বিকাশ আলোচনা কর।

ব্রিটিশ ভারতে উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির বিকাশ একটি ঐতিহাসিক এবং জটিল প্রক্রিয়া। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ পর্যন্ত এর বিবর্তন ঘটে। এই সময়ের মধ্যে মুসলিমদের রাজনৈতিক চেতনা, স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রাম বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠনের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সংস্কার আন্দোলন, কংগ্রেসের প্রতি মুসলিমদের সংশয়, বঙ্গভঙ্গ এবং মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। লক্ষ্ণৌ চুক্তি, খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো ঘটনাগুলো হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সম্ভাবনা তৈরি করলেও নেহেরু রিপোর্ট এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ মুসলিমদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক পথ অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি করে। আল্লামা ইকবালের দার্শনিক ভাবনা, জিন্নাহর চৌদ্দ দফা এবং লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে, যা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। এই দীর্ঘ পথচলা উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করে দেয়।

পড়ুন

খিলাফত আন্দোলনের কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা কর।

খিলাফত আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ ভারতে মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় এবং খলিফার মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। এর প্রধান কারণগুলো ছিল ধর্মীয় অনুভূতি, ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা। এই আন্দোলন হিন্দু-মুসলিম ঐক্য জোরদার করে এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর ফলে মুসলিম সমাজে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শক্তিশালী হয়।

পড়ুন