ভূমিকা
প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রাজ্ঞ এবং কূটনীতিবিদ আচার্য চাণক্য, যিনি কৌটিল্য ও বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন, তাঁর রাষ্ট্রদর্শন ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তিনি তার বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’-এ রাষ্ট্র, রাজনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ, আইন-কানুন, অর্থনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শন কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বাস্তব রাজনীতিতেও তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। তিনি মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করে মৌর্য সাম্রাজ্য স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শনের মূলনীতি
কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শনের মূলনীতিগুলি হলো রাজা, রাজত্ব, মন্ত্রী পরিষদ, প্রজা, আইন, শাস্তি, যুদ্ধনীতি, কূটনীতি ইত্যাদি।
১. রাষ্ট্রের সাতটি অঙ্গ
কৌটিল্য রাষ্ট্রকে একটি জৈবিক অঙ্গের সাথে তুলনা করেছেন যেখানে সাতটি অঙ্গ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। এই সাতটি অঙ্গ হলো রাজা (স্বামী), অমাত্য (মন্ত্রী), জনপদ (ভূমি ও জনগণ), দুর্গ (দুর্গ), কোষ (রাজকোষ), দণ্ড (বাহিনী) এবং মিত্র (মিত্ররাষ্ট্র)। কৌটিল্যের মতে, এই সাতটি অঙ্গের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব এবং সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
২. রাজার ভূমিকা ও গুণাবলী
কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শনে রাজা হলেন রাষ্ট্রের প্রধান ও কেন্দ্রবিন্দু। তিনি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস। তবে কৌটিল্য একজন স্বেচ্ছাচারী শাসকের পক্ষপাতী ছিলেন না। তার মতে, একজন আদর্শ রাজার উচিত ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক, জ্ঞানী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সাহসী, কর্মঠ এবং প্রজাবৎসল হওয়া। কৌটিল্য রাজাকে উপদেশ দিয়েছিলেন ধার্মিক নীতি অনুসরণ করতে, জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে।
৩. মন্ত্রী পরিষদের গুরুত্ব
কৌটিল্য রাষ্ট্র পরিচালনায় মন্ত্রী পরিষদের গুরুত্বের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন। তার মতে, একজন জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ মন্ত্রী পরিষদ রাজার ডান হাত। কৌটিল্য মন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, মন্ত্রীদের উচিত চরিত্রবান, জ্ঞানী, সৎ, নিষ্ঠাবান এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যশীল হওয়া। মন্ত্রীদের কাজ হলো রাজাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে সহায়তা করা এবং রাজার আদেশ বাস্তবায়ন করা।
৪. প্রজাহিতৈষী শাসন
কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শনে প্রজাদের স্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হলো প্রজা। প্রজাদের সুখ-সমৃদ্ধিতেই রাষ্ট্রের সুখ-সমৃদ্ধি নির্ভর করে। কৌটিল্য রাজাকে উপদেশ দিয়েছিলেন প্রজাদের কল্যাণে কাজ করতে, তাদের নিরাপত্তা বিধান করতে, তাদের অধিকার রক্ষা করতে এবং তাদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন না করতে। তিনি মনে করতেন, প্রজাদের সন্তুষ্টি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
৫. আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা
কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা অপরিহার্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিনি অপরাধ দমনের জন্য মৃত্যুদণ্ড, কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি এও মনে করতেন যে, শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা উচিত এবং নির্দোষ ব্যক্তির উপর যেন কোনো অত্যাচার না করা হয়।
৬. যুদ্ধ ও কূটনীতি
কৌটিল্য রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য যুদ্ধকে অনিবার্য বলে মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য যুদ্ধ করা রাজার কর্তব্য। তিনি তার ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে যুদ্ধের নীতিমালা, কৌশল এবং কৌশল সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তিনি চার ধরনের বাহিনীর কথা উল্লেখ করেছেন: পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তি বাহিনী এবং রথারোহী। তবে তিনি এও মনে করতেন যে, যুদ্ধ সর্বশেষ অস্ত্র হওয়া উচিত। যুদ্ধের আগে কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা উচিত।
৭. মণ্ডল তত্ত্ব
কূটনীতিতে কৌটিল্যের মণ্ডল তত্ত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্রকে তার ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ‘বিজয়ী’, ‘আরি’, ‘মিত্র’, ‘মধ্যস্থ’ ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। কৌটিল্য মনে করতেন, রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মণ্ডল তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৮. গুপ্তচরবৃত্তির উপর গুরুত্বারোপ
কৌটিল্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্বের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তার মতে, রাজার উচিত দেশে-বিদেশে গুপ্তচর নিয়োগ করা যারা তাকে সকল ধরণের গোপন তথ্য প্রদান করবে। এই গুপ্তচররা রাজাকে শত্রুদের
গতিবিধি, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত করবে।
৯. অর্থনৈতিক নীতি
কৌটিল্যের মতে, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য একটি সুসংগঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। তিনি কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি কর ব্যবস্থাকে জনগণের জন্য সহনীয় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে রাষ্ট্রের উচিত দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জনগণের সাহায্যে এগিয়ে আসা।
১০. নীতি ও ধর্ম
কৌটিল্য একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে রাজনীতিতে নীতি ও ধর্মের চেয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থই প্রধান। তিনি মনে করতেন যে, প্রয়োজনে রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাজা কূটনীতি ও যুদ্ধ দুটোই করতে পারেন। তবে তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে রাজার উচিত সর্বদা ন্যায় ও ধর্মের পথ অনুসরণ করা।
১১. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
কৌটিল্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, আছে শুধুমাত্র স্থায়ী স্বার্থ। তিনি রাষ্ট্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্ক ও সাবধান থাকতে।
১২. শিক্ষার গুরুত্ব
কৌটিল্য শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষিত জনগণই রাষ্ট্রের প্রকৃত সম্পদ। তিনি রাষ্ট্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে।
১৩. নারীর ভূমিকা
কৌটিল্যের সময়ে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। তথাপি কৌটিল্য নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারীরা পুরুষদের মতোই জ্ঞানী ও যোগ্য হতে পারে।
১৪. দাস প্রথা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি
কৌটিল্যের সময়ে ভারতে দাসপ্রথা ছিল। তিনি দাসপ্রথার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন না। তবে তিনি দাসদের প্রতি মানবিক আচরণের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে দাসদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করা উচিত নয়।
১৫. কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শনের সমালোচনা
কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শন অনেক সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেকে তার রাজনৈতিক নীতিকে অতি কঠোর ও নৃশংস বলে মনে করেন। তার গুপ্তচরবৃত্তির উপর অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ ও কূটনীতিতে ছল-চাতুরীর ব্যবহারের জন্য তাকে অনেকে moral ground থেকে সমালোচনা করেছেন। তবে তার সমালোচকরাও একথা স্বীকার করে নেন যে, কৌটিল্য ছিলেন একজন মহান রাজনীতিবিদ এবং তার রাষ্ট্রদর্শন প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাধারার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
উপসংহার
কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শন প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাধারার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। তার ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থ কেবল একটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থ নয়, বরং একটি জ্ঞানভাণ্ডার। এই গ্রন্থে রাষ্ট্র, রাজনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ, আইন-কানুন, অর্থনীতি, সমাজ ইত্যাদি নানা বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শন কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বাস্তব রাজনীতিতেও তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। তার রাষ্ট্রদর্শন পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনীতি চর্চার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। আজও তার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রশংসা করা হয়।