জেনারেল জিয়াউর রহমান (১৯৭৫-৮১) এবং জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের (১৯৮২-৯০) শাসনামলের একটি তুলনামূলক মূল্যায়ন কর। তাঁদের বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া, দল গঠন, প্রশাসনিক সংস্কার এবং গণতন্ত্রের উপর এর প্রভাব আলোচনা কর।
ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়কালটি نظامی শাসন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এই সময়ে দুইজন সামরিক শাসক, জেনারেল জিয়াউর রহমান (১৯৭৫-৮১) এবং জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (১৯৮২-৯০), রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং পরবর্তীতে নিজেদের শাসনকে বেসামরিকীকরণের প্রচেষ্টা চালান। যদিও উভয় শাসকই সামরিক পটভূমি থেকে এসেছিলেন এবং ক্ষমতা দখলের পর রাজনৈতিক দল গঠন করে শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের গৃহীত নীতি, প্রশাসনিক সংস্কার এবং গণতন্ত্রের উপর রেখে যাওয়া প্রভাবের মধ্যে সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য উভয়ই বিদ্যমান।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের এক জটিল রাজনৈতিক এবং সামরিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। অপরদিকে, ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। উভয় শাসকই নিজেদের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য বেসামরিকীকরণের একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন, যার মধ্যে গণভোট, নির্বাচন আয়োজন এবং নতুন রাজনৈতিক দল গঠন ছিল অন্যতম। তাঁদের এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে, যা আজও আলোচনার বিষয়। এই আলোচনায় তাঁদের শাসনামলের একটি তুলনামূলক মূল্যায়ন করা হলো।
ক্ষমতা গ্রহণ ও বৈধতা অর্জনের প্রক্রিয়া
জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ—উভয়েরই ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপট ছিল সামরিক হস্তক্ষেপ, তবে এর ধরণ এবং পরিস্থিতিতে ভিন্নতা ছিল। পরবর্তীতে তাঁরা প্রায় একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
১. জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ ও বৈধকরণ
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়। বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পর ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। প্রথমে তিনি উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তীতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ও শাসনের বৈধতা অর্জনের জন্য জিয়াউর রহমান কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন:
- গণভোট: তিনি ১৯৭৭ সালের ৩০শে মে একটি গণভোটের আয়োজন করেন, যেখানে তাঁর ১৯-দফা কর্মসূচির পক্ষে জনগণের আস্থা যাচাই করা হয়। সরকারি তথ্যমতে, এই গণভোটে ৯৯ শতাংশের বেশি 'হ্যাঁ' ভোট পড়ে, যা তাঁর শাসনকে একটি আপাত বৈধতা প্রদান করে।
- রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: এরপর ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। এই নির্বাচনে তিনি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল (অব.) এম. এ. জি. ওসমানীকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
২. এইচ. এম. এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ ও বৈধকরণ
১৯৮১ সালের ৩০শে মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ দেখিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।
জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করে এরশাদও তাঁর শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন:
- গণভোট: ১৯৮৫ সালের ২১শে মার্চ এরশাদ তাঁর গৃহীত নীতি ও কর্মসূচির উপর জনগণের আস্থা যাচাইয়ের জন্য একটি গণভোট আয়োজন করেন। এই গণভোটেও তাঁর পক্ষে বিপুল 'হ্যাঁ' ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
- রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: ১৯৮৬ সালের ১৫ই অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ না করায় তিনি সহজেই নির্বাচিত হন।
উভয় শাসকের ক্ষেত্রেই গণভোট ও নির্বাচনগুলো বিরোধী দলগুলোর বর্জনের কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল এবং এগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া ও দল গঠন
উভয় সামরিক শাসকই অনুধাবন করেছিলেন যে, শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা নিজেদের বেসামরিক শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এবং রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি তৈরি করতে দল গঠনের পথে হাঁটেন।
১. জিয়াউর রহমানের বেসামরিকীকরণ ও বিএনপি গঠন
জিয়াউর রহমান তাঁর সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দিতে একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করেন।
- রাজনৈতিক দলবিধি: ১৯৭৬ সালে তিনি "রাজনৈতিক দলবিধি" জারি করে ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি দেন, যা বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
- জাগদল থেকে বিএনপি: প্রথমে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠন করেন। পরবর্তীতে, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের নেতা-কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলটি ডান, বাম ও মধ্যপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল, যার মূল ভিত্তি ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।
- সংসদ নির্বাচন: ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নবগঠিত বিএনপি ২০৭টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনকে একটি পূর্ণাঙ্গ বেসামরিক রূপ দেন।
২. এইচ. এম. এরশাদের বেসামরিকীকরণ ও জাতীয় পার্টি গঠন
জেনারেল এরশাদও জিয়াউর রহমানের মডেল অনুসরণ করে নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
- জনদল থেকে জাতীয় পার্টি: প্রথমে তিনি 'জনদল' নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। পরবর্তীতে, ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি বিভিন্ন দলছুট নেতা এবং সমর্থকদের নিয়ে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এরশাদ এই দলের চেয়ারম্যান হন এবং দলটিকে তাঁর বেসামরিকীকরণের প্রধান রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করেন।
- বিতর্কিত নির্বাচন: এরশাদের অধীনে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনগুলো বর্জন করায় এবং ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠায় এগুলো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ২৫১টি আসন লাভ করে।
উভয় ক্ষেত্রেই দল গঠন প্রক্রিয়াটি ছিল 'উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া' (top-down) প্রকৃতির, যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধাকে ব্যবহার করে দল তৈরি করা হয়েছিল। এর ফলে, এই দলগুলোর মধ্যে আদর্শিক দৃঢ়তার চেয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়।
প্রশাসনিক সংস্কার
জিয়াউর রহমান ও এইচ. এম. এরশাদ—উভয়েই প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন, যা বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে।
১. জিয়াউর রহমানের প্রশাসনিক সংস্কার: গ্রাম সরকার
জিয়াউর রহমানের অন্যতম প্রশাসনিক সংস্কার ছিল গ্রামীণ পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
- উদ্দেশ্য: এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা, গ্রামীণ নেতৃত্ব তৈরি করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিচার-সালিশ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
- গঠন: ১৯৮০ সালে এই ব্যবস্থা চালু হয়। প্রতিটি গ্রামে একজন গ্রাম প্রধান এবং нескольких সদস্য নিয়ে গ্রাম সরকার গঠিত হতো, যেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হতো।
- প্রভাব: গ্রাম সরকার ব্যবস্থা গ্রামীণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতা চর্চার একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। তবে এর কার্যকারিতা এবং ইউনিয়ন পরিষদের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক ছিল। জিয়ার মৃত্যুর পর এই ব্যবস্থাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
২. এইচ. এম. এরশাদের প্রশাসনিক সংস্কার: উপজেলা পদ্ধতি
এইচ. এম. এরশাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রশাসনিক সংস্কার হলো উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন।
- উদ্দেশ্য: প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এবং স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের কেন্দ্র হিসেবে উপজেলাকে শক্তিশালী করা ছিল এর মূল লক্ষ্য।
- বাস্তবায়ন: ১৯৮২ সালে একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে থানাগুলোকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয় এবং নির্বাচিত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে উপজেলা পরিষদ গঠন করা হয়। উপজেলা পর্যায়ে বিচারিক কার্যক্রমের জন্য মুন্সেফ কোর্ট স্থাপন করা হয়।
- প্রভাব: উপজেলা পদ্ধতি বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটি স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যদিও এরশাদের পতনের পর ব্যবস্থাটি সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছিল, পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এর पुनरुत्थान ঘটেছে এবং এটি এখনও বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হিসেবে বিদ্যমান।
তুলনামূলকভাবে, এরশাদের উপজেলা পদ্ধতি জিয়ার গ্রাম সরকার ব্যবস্থার চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেশি শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।
গণতন্ত্রের উপর প্রভাব
জিয়াউর রহমান এবং এইচ. এম. এরশাদের শাসনামল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উপর মিশ্র এবং বিতর্কিত প্রভাব ফেলেছে। যদিও তাঁরা উভয়েই বহুদলীয় রাজনীতির সুযোগ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
১. ইতিবাচক দিক (বিতর্কিত)
- বহুদলীয় রাজনীতির পুনঃপ্রবর্তন (জিয়া): জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশকে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। তিনি আওয়ামী লীগসহ অনেক রাজনৈতিক দলকে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ দেন।
- ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: জিয়ার গ্রাম সরকার এবং এরশাদের উপজেলা পদ্ধতি—উভয়ই ছিল ক্ষমতাকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা, যা স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
২. নেতিবাচক প্রভাব
- সামরিকীকরণ: উভয় শাসকের সময়েই প্রশাসন ও রাজনীতিতে সামরিক কর্মকর্তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, যা বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেয়।
- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়: নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, গণভোট এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠনের মাধ্যমে তাঁরা গণতন্ত্রের একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করলেও এর অন্তর্নিহিত শক্তিকে খর্ব করেন। নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংসদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গুরুত্ব হারায়।
- সংবিধানের বিতর্কিত সংশোধন: জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন আনেন, যেমন 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র পরিবর্তে 'আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' স্থাপন। এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এই পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে।
- রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে দল গঠন এবং নেতাদের কেনা-বেচার রাজনীতির যে ধারা শুরু হয়েছিল, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে রাজনীতিতে সুবিধাবাদ এবং দুর্নীতির বিস্তার ঘটে বলে সমালোচকরা মনে করেন।
উপসংহার
জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের শাসনামলের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, তাঁদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে সাদৃশ্য বিদ্যমান ছিল। উভয়েই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন, গণভোট ও নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন, এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠন করে বেসামরিক শাসকে রূপান্তরিত হতে চেয়েছিলেন।
তবে তাঁদের প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। জিয়াউর রহমানের গ্রাম সরকার একটি তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোগ হলেও তা স্বল্পস্থায়ী ছিল, অন্যদিকে এরশাদের উপজেলা পদ্ধতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার হিসেবে অধিকতর টেকসই প্রমাণিত হয়েছে।
উভয় শাসকের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। তাঁদের শাসনামলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে এবং রাজনীতিতে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও তাঁরা কিছু উন্নয়নমূলক ও সংস্কারধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের শাসনব্যবস্থা本质ত অগণতান্ত্রিক প্রকৃতির ছিল এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আজও প্রভাবিত করে চলেছে।
১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের (৫ম থেকে ১১শ) প্রেক্ষাপট, ফলাফল এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য পৃথকভাবে বিশ্লেষণ কর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা (ত্রয়োদশ সংশোধনী) প্রবর্তনের কারণ এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিলের পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলো কী ছিল? বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এর প্রভাব সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ কর।
সম্পর্কিত পোস্ট
একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা এই লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।