ভূমিকা
বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে জীববৈচিত্র্য ক্রমবর্ধমান হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আজ বিশ্বব্যাপী একটি অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ, একটি জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার, বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) এবং স্থানীয় সম্প্রদায়গুলির সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত কার্যক্রম
বাংলাদেশ সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে নীতিমালা প্রণয়ন, আইন প্রণয়ন, সংরক্ষিত এলাকা স্থাপন, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য।
১. নীতিমালা এবং আইনি কাঠামো
বাংলাদেশ সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য একটি শক্তিশালী নীতিমালা এবং আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (এনবিএসএপি), ২০০৪, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য একটি ব্যাপক রোডম্যাপ প্রদান করে। এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, টেকসই ব্যবহার এবং জেনেটিক সম্পদের ন্যায্য এবং ন্যায়সঙ্গত বন্টনের মতো বিষয়গুলিকে সম্বোধন করে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫, বন আইন, ১৯২৭, এবং বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য আইনি ভিত্তি প্রদান করে।
২. সংরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে তার স্থলভাগ এবং জলজ পরিবেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সংরক্ষিত এলাকা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই এলাকাগুলি প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র, বিপন্ন প্রজাতি এবং গুরুত্বপূর্ণ বাসস্থান রক্ষা করে। বাংলাদেশে ১৭টি জাতীয় উদ্যান, ৫টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ৪১টি ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ), এবং অন্যান্য সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। এই এলাকাগুলির ব্যবস্থাপনার জন্য বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো বিভিন্ন সরকারি সংস্থা দায়িত্বপ্রাপ্ত।
৩. বন ব্যবস্থাপনা
বন জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল, এবং বাংলাদেশ সরকার বন সংরক্ষণ এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, যার ফলে বনভূমির আওতা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বন আইন, ১৯২৭ এবং সংশোধিত আইন অনুযায়ী বন ধ্বংস রোধ, অবৈধভাবে গাছ কাটা বন্ধ এবং বন সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
৪. জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ এবং প্রাণবৈচিত্র্যপূর্ণ জলজ বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। মাছের মজুদ সুরক্ষা, জল দূষণ রোধ এবং টেকসই মৎস্য আহরণ অনুশীলন প্রচারের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মৎস্য আইন, ২০১২, জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রদান করে। মাছের প্রজনন মৌসুমে নির্দিষ্ট কিছু প্রজাতির মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা জারি করা হয়।
৫. বিপন্ন প্রজাতি সংরক্ষণ
বাংলাদেশে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, এশিয়াটিক হাতি, গঙ্গা নदीর শুশুক (ডলফিন) সহ অনেকগুলি বিপন্ন প্রজাতি রয়েছে। এই প্রজাতিগুলির সংরক্ষণের জন্য সরকার জাতীয় সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা (এনসিএপি) তৈরি করেছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২, বিপন্ন প্রজাতিদের শিকার, পাচার এবং বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে। বিপন্ন প্রজাতি সংরক্ষণে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
৬. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের উপর একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্য জাতীয় অভিযোজন কর্মসূচি (এনএপি) প্রণয়ন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর জন্য উপকূলীয় বনায়ন, জলাভূমি সংরক্ষণ এবং বন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
৭. গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপর গবেষণা এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই), বন্যপ্রাণী গবেষণা কেন্দ্র (ডব্লিউআরসি), এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা প্রদান করে। এই গবেষণা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নীতিমালা এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল তৈরিতে সহায়তা করে।
৮. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা অপরিহার্য। সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি এবং প্রচারাভিযান পরিচালনা করে। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রমে পরিবেশগত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টেলিভিশন, রেডিও এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা হচ্ছে।
৯. স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ
স্থানীয় সম্প্রদায়গুলি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকার স্থানীয় সম্প্রদায়কে জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করার জন্য সহ-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। স্থানীয় সম্প্রদায়কে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং সুরক্ষায় ক্ষমতায়িত করার জন্য সামাজিক বনায়ন এবং ইকোট্যুরিজমের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
১০. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য জাতিসংঘের কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি (সিবিডি) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং আর্থিক সহায়তা বিনিময় করার জন্য দেশটি অন্যান্য দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতা করে।
১১. বাজেট এবং তহবিল
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল অপরিহার্য। বাংলাদেশ সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মসূচির জন্য তার বার্ষিক বাজেট থেকে তহবিল বরাদ্দ করে। সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক সাহায্য এবং অনুদানও গ্রহণ করে। তবে, তহবিলের অভাব এখনও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
১২. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নীতিমালা তৈরি এবং বাস্তবায়নের জন্য নোডাল মন্ত্রণালয়। বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো বিভিন্ন সরকারি সংস্থা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে। তবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং সক্ষমতা সীমাবদ্ধতা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় बाधा সৃষ্টি করতে পারে।
১৩. আইন প্রয়োগ
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আইন প্রয়োগ অপরিহার্য। সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়। তবে, দুর্বল আইন প্রয়োগ, দুর্নীতি এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
উপসংহার
বাংলাদেশ তার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নীতিমালা প্রণয়ন, সংরক্ষিত এলাকা স্থাপন, বনায়ন কর্মসূচি এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার দেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে, জীববৈচিত্র্যের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ, যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য, আইন প্রয়োগ জোরদার করা, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য টেকসই তহবিল নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।