নারী ক্ষমতায়নের সংজ্ঞা দাও। নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা

নারী ক্ষমতায়ন হচ্ছে নারীদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে – রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং পারিবারিক – সমান অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ক্রমাগত প্রক্রিয়া। এটি কেবল নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই নয়, বরং নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত, টেকসই এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত।

নারী ক্ষমতায়নের সংজ্ঞা

নারী ক্ষমতায়ন একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা কেবল নারীর আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

১. ক্ষমতার ধারণা

নারী ক্ষমতায়ন বোঝার জন্য প্রথমেই আমাদের ক্ষমতার ধারণাটি বুঝতে হবে। ক্ষমতা বলতে সাধারণত কারো পক্ষে কিছু করার সামর্থ্য বোঝায়। নারীদের ক্ষেত্রে, ক্ষমতা হলো তাদের নিজেদের জীবন এবং তাদের চারপাশের জগতের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা।

২. ক্ষমতায়নের স্তম্ভ

নারী ক্ষমতায়ন বিভিন্ন স্তম্ভের উপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, আইনি সুরক্ষা, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার।

৩. ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্য

নারী ক্ষমতায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করে নারীদের সমাজের সকল স্তরে পূর্ণ ও সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতা

নারী ক্ষমতায়নের পথে বহু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত।

৪. সামাজিক প্রতিবন্ধকতা

পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, নারীর প্রতি সামাজিক ধারণা, বাল্যবিবাহ, জোরপূর্বক বিবাহ, পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুক প্রথা, নারী পাচার ইত্যাদি।

৫. অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা

শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্য, সম্পত্তির অধিকারের অভাব, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভাব, নারীর কাজের স্বীকৃতি না থাকা, নারীর আয় ও সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব ইত্যাদি।

৬. রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা

রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণের অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর প্রতিনিধিত্বের অভাব, রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণে সামাজিক বাধা, নারী রাজনীতিবিদদের প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি।

৭. সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা

ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, নারীর ভূমিকা সম্পর্কে রক্ষণশীল ধারণা, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক চিত্রায়ন ইত্যাদি।

৮. আইনি প্রতিবন্ধকতা

যদিও বাংলাদেশে নারীর অধিকার রক্ষায় অনেক আইন রয়েছে, তবে বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আইনের অজ্ঞতা, আইনের প্রয়োগে দুর্বলতা, সামাজিক প্রভাবের কারণে আইনের আশ্রয় গ্রহণে নারীর অনিচ্ছা ইত্যাদি।

৯. শিক্ষার অভাব

শিক্ষা নারী ক্ষমতায়নের একটি প্রধান হাতিয়ার। নারীদের শিক্ষার অভাব তাদের সচেতনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং সমাজে সমান অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।

১০. স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা

প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার অভাব, পুষ্টির অভাব, মা ও শিশু মৃত্যুর উচ্চ হার ইত্যাদি কারণে নারীরা প্রায়ই দুর্বল থাকে এবং তাদের সম্ভাব্য ক্ষমতা প্রকাশে ব্যর্থ হয়।

১১. প্রযুক্তিগত বৈষম্য

তথ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারে বৈষম্য, ডিজিটাল শিক্ষার অভাব ইত্যাদি তাদের জন্য নতুন ধরণের বৈষম্যের সৃষ্টি করে।

উপসংহার

নারী ক্ষমতায়ন কেবল নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে, নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূরীকরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি ন্যায়সঙ্গত, সমতাভিত্তিক এবং টেকসই সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *