বাংলাদেশের কর কাঠামোর বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা

বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক হাতিয়ার হলো কর ব্যবস্থা। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা, জনগণের জন্য বিভিন্ন সেবা প্রদান, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান আসে মূলত কর থেকে। সরকার কর ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন খাত থেকে রাজস্ব আহরণ করে এবং সেই অর্থ দিয়ে জনকল্যাণমূলক কাজ করে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ও সম্প্রসারণ হয়েছে। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাহিদা, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব এবং কর ব্যবস্থার সংস্কারের প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশের কর কাঠামোর বৈশিষ্ট্যসমূহ

বাংলাদেশের কর কাঠামো মূলত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর এই দুই ভাগে বিভক্ত। প্রত্যক্ষ কর বলতে আয়কর, সম্পত্তিকর ইত্যাদি বুঝায় যা সরাসরি আয় বা সম্পত্তির উপর আরোপ করা হয়। অন্যদিকে, পরোক্ষ কর বলতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক ইত্যাদি বুঝায় যা পণ্য ও সেবার উপর আরোপিত হয় এবং ভোক্তাদের মাধ্যমে সরকারের কাছে আসে।

১. প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থা

বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার মূল উপাদান হলো আয়কর। আয়কর আইন, ১৯৮৪ অনুযায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর আয়কর আরোপ করা হয়। বেতনভুক্ত চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, স্বাধীন পেশাজীবী, কোম্পানি ইত্যাদি সকলের উপর আয়ের উপর কর প্রযোজ্য। তবে, আয়করের সীমা, কর হার, কর রেয়াত ইত্যাদি বিষয়ে সরকার সময়ে সময়ে পরিবর্তন আনে।

২. পরোক্ষ কর ব্যবস্থা

বাংলাদেশের পরোক্ষ কর ব্যবস্থায় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূসক আইন, ২০১২ অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে পণ্য ও সেবার উৎপাদন, বিক্রয় ও সরবরাহের প্রতিটি স্তরে মূসক আরোপ করা হয়। এছাড়াও, আমদানি ও রপ্তানির উপর শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, এবং বিভিন্ন পণ্যের উপর কর আরোপ করা হয়।

৩. কর-জিডিপি অনুপাত

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত তুলনামূলকভাবে কম। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম, যা দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেমন- করের আওতা বৃদ্ধি, কর ফাঁকি রোধ, কর প্রশাসন ডিজিটালাইজেশন ইত্যাদি।

৪. কর অঞ্চল ও কর কর্মকর্তা

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর আদায়ের সুবিধার্থে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে একাধিক কর অঞ্চল। প্রতিটি কর অঞ্চলে কর কর্মকর্তাগণ কর আদায়, কর রিটার্ন জমা গ্রহণ, কর ফাঁকি রোধ, এবং কর সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন।

৫. কর নীতি

বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে কর নীতি ঘোষণা করে থাকে। কর নীতির মাধ্যমে সরকার কর হার, কর রেয়াত, কর অবকাশ, এবং কর সংক্রান্ত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। কর নীতির লক্ষ্য থাকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা, বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, কর আহরণ বৃদ্ধি করা এবং সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত করা।

৬. কর রেয়াত ও কর অবকাশ

বাংলাদেশ সরকার দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের কর রেয়াত ও কর অবকাশ প্রদান করে থাকে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানিমুখী শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে কর রেয়াত ও কর অবকাশ প্রদান করা হয়।

৭. কর ফাঁকি ও রোধ

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর ফাঁকি। অনেকেই আইনত কর পরিধি থেকে বিভিন্ন উপায়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকে, যা সরকারের রাজস্ব আয় কমিয়ে দেয়। কর ফাঁকি রোধে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেমন- কর প্রশাসন জোরদার, আইনগত জটিলতা নিরসন, সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।

৮. কর প্রশাসন ডিজিটালাইজেশন

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের কর প্রশাসন ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড করদাতাদের সুবিধার্থে অনলাইন কর রিটার্ন জমার ব্যবস্থা চালু করেছে। এছাড়াও, অনলাইনে কর পরিশোধ, কর সংক্রান্ত তথ্য জানা, কর পরিশোধের সনদপত্র ডাউনলোড ইত্যাদি সুযোগ রয়েছে।

৯. কর সংস্কার

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সময়ে সময়ে কর সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কর সংস্কারের লক্ষ্য থাকে কর ব্যবস্থাকে সরলীকরণ, করের আওতা বৃদ্ধি, কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, কর প্রশাসন জোরদার, এবং করদাতাদের সেবা নিশ্চিত করা।

১০. বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব

বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারকে কর নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হয়।

১১. আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে কর সংস্কার, কর প্রশাসন জোরদার, এবং কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে।

১২. সুশাসনের ভূমিকা

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার উন্নয়নে সুশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। সুষ্ঠু, জবাবদিহিমূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত কর প্রশাসন কর আহরণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করে, যা কর ব্যবস্থার প্রতি তাদের ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করে।

১৩. চ্যালেঞ্জসমূহ

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কর-জিডিপি অনুপাত কম, কর ফাঁকি, জটিল কর আইন, দুর্বল কর প্রশাসন, দুর্নীতি ইত্যাদি। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে একটি আধুনিক, দক্ষ এবং গতিশীল কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা বাংলাদেশের জন্য জরুরি।

১৪. সুপারিশ

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা যায়। কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে করের আওতা বৃদ্ধি, কর ফাঁকি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, কর আইন সরলীকরণ, কর প্রশাসন জোরদার, এবং করদাতাদের সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে কর ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল ও উন্নত করা সম্ভব।

১৫. ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। অর্থনীতির এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য একটি শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল কর ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কর ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে দেশের টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। বর্তমানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হলে কর ব্যবস্থার আরও সংস্কার ও আধুনিকীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ এবং জনগণের সচেতনতার মাধ্যমে বাংলাদেশের কর ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল ও উন্নত করে দেশের টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *