বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা:

বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে জনসংখ্যার কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য জনসংখ্যার কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:

১. জনসংখ্যার আকার ও ঘনত্ব:

বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম সর্বাধিক জনবহুল দেশ। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ১,২৬৫ জন, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ জনঘনত্বের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই বিপুল জনসংখ্যা দেশের সীমিত সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। তবে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমশ কমছে।

২. বয়স কাঠামো:

বাংলাদেশের জনসংখ্যার বয়স কাঠামো পিরামিড আকৃতির। জনসংখ্যার প্রায় ২৮% এর বয়স ১৫ বছরের নিচে, ৬৫% এর বয়স ১৫-৬৪ বছরের মধ্যে এবং মাত্র ৭% এর বয়স ৬৫ বছরের উপরে। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বাংলাদেশের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। কর্মক্ষম জনসংখ্যার এই বিশাল অংশ যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।

৩. লিঙ্গ অনুপাত:

বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন পুরুষের বিপরীতে ৯৭.১ জন নারী রয়েছে। এই লিঙ্গ অনুপাত ক্রমশ ভারসাম্যপূর্ণ হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমছে।

৪. নগরায়ন ও অভিবাসন:

বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৮% শহরাঞ্চলে বাস করে। গ্রাম থেকে শহরে জনসংখ্যার অভিপ্রয়াণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন রেমিট্যান্স আয় বাড়ছে, অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে শ্রমিক সংকট দেখা দিচ্ছে।

৫. শিক্ষার হার:

বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার বর্তমানে প্রায় ৭৫%। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় ১০০%। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার এখনো উচ্চ। সরকারের বিভিন্ন শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রমের ফলে শিক্ষার হার ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি লক্ষণীয়।

৬. স্বাস্থ্য সূচক:

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সূচকগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, গড় আয়ু বেড়েছে, মাতৃ স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে গড় আয়ু ৭২ বছর। তবে স্বাস্থ্যসেবার মান ও প্রাপ্যতা নিয়ে এখনো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

৭. কর্মসংস্থান:

বাংলাদেশের শ্রমশক্তির আকার প্রায় ৬.৫ কোটি। প্রতিবছর প্রায় ২০ লক্ষ নতুন শ্রমশক্তি যোগ হচ্ছে। এদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বেকারত্বের হার প্রায় ৪.২%। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৮. পারিবারিক কাঠামো:

বাংলাদেশে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ক্রমশ একক পরিবার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে। পরিবারের গড় আকার কমে প্রায় ৪.৫ জনে দাঁড়িয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের সফলতার ফলে জন্মহার কমেছে। বর্তমানে মোট প্রজনন হার ২.১।

৯. ধর্মীয় ও জাতিগত বৈচিত্র্য:

বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০% মুসলিম, ৮.৫% হিন্দু এবং বাকি ১.৫% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। এছাড়া দেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। এই বৈচিত্র্য বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।

১০. দারিদ্র্যের হার:

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ক্রমশ কমছে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার প্রায় ২০%। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এবং বিভিন্ন আয়বর্ধক প্রকল্পের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত হচ্ছে।

উপসংহার:

বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সুযোগও রয়েছে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এজন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে জনসংখ্যাকে কার্যকর মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। তবেই বাংলাদেশ তার উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *