ভূমিকা
গণতন্ত্রের ধারণাটিই পুরুষ ও নারী উভয়ের সমান অংশগ্রহণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতি হচ্ছে সমাজ পরিচালনার মূল হাতিয়ার এবং উন্নয়নের ধারা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই, রাজনীতিতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। ঐতিহাসিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, সহিংসতা এবং নিরাপত্তার অভাব – এসব কারণে নারীদের রাজনীতিতে পূর্ণ মাত্রায় অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশে নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যা ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে গড়ে উঠেছে।
১. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা এখনও পুরুষতান্ত্রিক। নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রীতিনীতি তাদেরকে গৃহকর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে উৎসাহিত করে। নারীদের রাজনীতিতে আসা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার ও সমাজে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। তাদের চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা হয়। পর্দা প্রথা, পুরুষ অভিভাবক ছাড়া ঘরের বাইরে চলাফেরায় বাধা, অন্যের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা – এসব সামাজিক রীতিনীতির কারণে নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
২. ধর্মীয় গোঁড়ামি
বাংলাদেশে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় মতবাদের অপব্যাখ্যার ফলে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হয়। নারীদের নেতৃত্ব গ্রহণের বিষয়টি ধর্মীয়ভাবে অনুমোদিত নয় বলে কিছু ধর্মীয় গোঁড়া মহল ক্রমাগত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
৩. অর্থনৈতিক বৈষম্য
অর্থনৈতিকভাবে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাব নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান অন ্যতম প্রতিবন্ধকতা। রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য অর্থ, সময় এবং সম্পদের প্রয়োজন হয়, যা অনেক নারীর কাছে অনুপস্থিত থাকে।
৪. শিক্ষার অভাব
শিক্ষার অভাব নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশে এখনও অনেক নারী নিরক্ষর এবং শিক্ষিত নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় কম। রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, আইন ও নীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা নারীদেরকে পিছিয়ে রাখে।
৫. রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা
রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ও পুরুষ নেতৃত্বের আধিপত্য নারীদের রাজনীতিতে প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে নারীদেরকে শুধুমাত্র ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাদেরকে নেতৃত্বে দেখতে চায় না। মনোনয়ন প্রদানে নারীদের প্রতি বৈষম্য করা হয়।
৬. সহিংসতা ও নিরাপত্তার অভাব
রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সহিংসতা এবং নিরাপত্তার অভাব একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। নারী প্রার্থীরা প্রায়ই নানা ধরনের হুমকি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়াও, রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য তাদেরকে প্রায়ই পুরুষ সদস্যদের তুলনায় বেশি ঝুঁকি নিতে হয়।
৭. গণমাধ্যমের ভূমিকা
গণমাধ্যমকে সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। কিন্তু নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যম নারীদেরকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী স্থান দিতে নারাজ। নারী রাজনীতিবিদদেরকে প্রায়ই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অপ্রয়োজনীয় আলোচনা করা হয়।
৮. আইনি প্রতিবন্ধকতা
যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তবুও বাস্তবক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগে অনেক বৈষম্য বিদ্যমান । কিছু ক্ষেত্রে আইন পুরুষদের পক্ষেই বেশি সক্রিয় ।
৯. নেটওয়ার্কিং এর অভাব
রাজনীতিতে সফল হতে হলে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত রাজনীতিতে নারীরা এই নেটওয়ার্ক থেকে বঞ্চিত।
১০. পরিবারের সহযোগিতার অভাব
অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পরিবারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পান না । পরিবারের সদস্যরা অনেক সময় নারীদের রাজনীতিতে আসার পক্ষে থাকেন না ।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোধগম্য হয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বহু প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। এজন্য সামাজিক চেতনা জাগ্রত করা, শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা সৃষ্টি করা, রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা পরিবর্তন করা এবং নারীদের প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা অত্যাবশ্যক।