ভূমিকা
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং তাদের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে স্বাধীনতার পর থেকেই এই শ্রেণিটির দ্রুত প্রসার ঘটেছে, অন্যদিকে তাদের জীবনযাত্রার মান, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, এবং সামাজিক মূল্যবোধের উপর নানা ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। এই আলোচনায় আমরা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ইতিহাস, তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা, এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রবণতা বিশ্লেষণ করব।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ এক জটিল এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়
মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ বুঝতে হলে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা জরুরী। ঔপনিবেশিক যুগে শিক্ষিত এবং পেশাজীবী একটি ছোট মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। পাকিস্তান আমলে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ফলে এই শ্রেণির আকার কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তবে সামগ্রিকভাবে তারা ছিল সংখ্যায় কম এবং রাজনৈতিকভাবে অপ্রভাবশালী।
২. স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দশক
স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য বিরাট প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। এই সময়ে রাষ্ট্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প এবং পরিষেবা খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা নতুন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এই সময়ে শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা এবং কিছু পেশাজীবী নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে উঠে আসেন।
৩. উদারীকরণ এবং গোলকায়ন
আশির দশকের শেষের দিকে এবং নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে উদারীকরণ এবং গোলকায়নের নীতি গ্রহণ করা হয়। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের যোগদানের ফলে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্রুত প্রসার ঘটে। এই শ্রেণিটি প্রধানত বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থান, ব্যবসা এবং পেশার সাথে যুক্ত ছিল। তারা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি উদ্যোগশীল এবং ঝুঁকি গ্রহণে সাহসী।
৪. পোশাক শিল্প এবং প্রবাসী আয়ের ভূমিকা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্প এবং প্রবাসী আয়ের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। পোশাক শিল্প বিপুল সংখ্যক নারী কর্মীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা অনেক পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো টাকা অনেক পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে এবং তাদেরকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করেছে।
৫. নতুন প্রজন্মের মধ্যবিত্ত
একুশ শতকের প্রথম দশক থেকে একটি নতুন প্রজন্মের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে। তারা প্রধানত তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবহন, যোগাযোগ এবং অন্যান্য পরিষেবা খাতের সাথে যুক্ত। এই শ্রেণিটি আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি বেশি আগ্রহী, বিশ্বায়নের প্রতি উন্মুক্ত এবং রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ পূর্বের তুলনায় বেশি সোচ্চার।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য এবং বিভাজন
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটি একক এবং সমজাতীয় শ্রেণি নয়। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্তর, আয়, পেশা, জীবনযাত্রার মান এবং মূল্যবোধের পার্থক্য।
৬. আয় এবং পেশাগত বিভাজন
মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রধানত উচ্চ, মধ্য এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত – এই তিন ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। উচ্চ মধ্যবিত্তরা প্রধানত বৃহৎ ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং শিল্পপতিদের নিয়ে গঠিত। মধ্যবিত্তরা প্রধানত ছোট ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যাংকার এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের নিয়ে গঠিত। নিম্ন-মধ্যবিত্তরা প্রধানত কেরানি, ছোট দোকানদার, সরকারি -বেসরকারি খাতের নিম্ন পদস্থ কর্মী এবং দক্ষ শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত।
৭. ভৌগলিক বিভাজন
শহর এবং গ্রামের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। শহুরে মধ্যবিত্তরা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা ভোগ করে। অন্যদিকে, গ্রামীণ মধ্যবিত্তরা প্রধানত কৃষি, ছোট ব্যবসা এবং স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের উপর নির্ভরশীল।
৮. সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ
মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পরিবর্তনশীল। একদিকে তারা পরিবার, ধর্ম এবং ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়। অন্যদিকে, তারা শিক্ষা, সম্পদ এবং সামাজিক মর্যাদার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী। তারা তাদের সন্তানদেরকে ভালো শিক্ষা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রয়াসী হয়।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা
বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৯. অর্থনৈতিক ভূমিকা
মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। তারা দেশের মোট ঘरेলু উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উৎপাদন করে এবং বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার জন্য ব্যয় করে। তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১০. রাজনৈতিক ভূমিকা
ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পিছনে তাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে, তারা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং গণতন্ত্র, সুশাসন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
১১. সামাজিক পরিবর্তনের ভূমিকা
মধ্যবিত্ত শ্রেণি সামাজিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। তারা নারী শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সমাজে নতুন নতুন ভাবনা ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
১২. জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি
বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তীব্র চাপের মধ্যে পড়ছে।
১৩. কর্মসংস্থানের অভাব
প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী কর্ম জগতে প্রবেশ করছে, কিন্তু তাদের জন্য পर्याप्त কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এই কারণে অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী ব্যর্থ হচ্ছে এবং হতাশায় ভুগছে।
১৪. সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি
বাংলাদেশে ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৈষম্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর প্রভাব ফেলছে। তাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে যে দেশের উন্নয়নের সুফল সমাজের সকল স্তরে সমানভাবে পৌঁছে যাচ্ছে না।
১৫. রাজনৈতিক অস্থিরতা
রাজনৈতিক অস্থিরতা মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক হানাহানি এবং অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হয় এবং বিনিয়োগ হ্রাস পায়। এছাড়াও, রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে।
উপসংহার
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা। এই শ্রেণিটি দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, তাদেরকে বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি খাত এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।