১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকা:

১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নেতৃত্বে বাংলার সৈন্যবাহিনী এবং রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর মধ্যকার এই যুদ্ধের ফলাফল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা করে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ, যেগুলোর সমন্বয়ে পলাশীর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের কারণসমূহ

১. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক উচ্চাভিলাষ:

১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির লক্ষ্য পরিবর্তিত হয় এবং তারা বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে উদ্যোগী হয়। বাংলার সমৃদ্ধ সম্পদ, বিশেষ করে মসলিন, রেশম এবং অন্যান্য দামী পণ্যের প্রতি কোম্পানির আগ্রহ তাদের বাংলা দখলের উচ্চাভিলাষকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পলাশীর যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে।

২. বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা:

সিরাজ-উদ-দৌলার রাজত্বকালে বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সিরাজের কঠোর শাসন এবং স্বেচ্ছাচারিতা তার বিরুদ্ধে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন নবাবের সেনাপতি মীর জাফর, রাজস্বমন্ত্রী রায় দুর্লভ এবং জগৎ শেঠ। রবার্ট ক্লাইভ এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মীর জাফরকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন। এই অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র পলাশীর যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।

৩. সিরাজ-উদ-দৌলার ইংরেজদের প্রতি বিরূপ মনোভাব:

সিরাজ-উদ-দৌলার ইংরেজদের প্রতি বিরূপ মনোভাব ছিল পলাশীর যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ইংরেজরা বাংলায় তাদের বাণিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নবাবের ফরমান অমান্য করে কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। এছাড়াও তারা বাংলার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করে। সিরাজ এই হস্তক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়িত করেন। এই ঘটনা ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তোলে এবং পলাশীর যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে।

৪. কলকাতার ‘ব্ল্যাক হোল’ ট্র্যাজেডি:

১৭৫৬ সালে সিরাজ-উদ-দৌলার সৈন্যরা কলকাতা দখল করে এবং ইংরেজদের একটি ছোট কারাগারে বন্দী করে। এই কারাগারে বন্দী অবস্থায় অনেক ইংরেজ মারা যায়। এই ঘটনাকে ‘ব্ল্যাক হোল’ ট্র্যাজেডি নামে অভিহিত করা হয়। যদিও এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবুও এই ঘটনা ইংরেজদের মধ্যে সিরাজের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং পলাশীর যুদ্ধের জন্য ইংরেজদের মনোবলকে শক্তিশালী করে।

৫. রবার্ট ক্লাইভের কূটনৈতিক এবং সামরিক দক্ষতা:

রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন একজন দক্ষ কূটনীতিবিদ এবং সামরিক নেতা। তিনি বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে মীর জাফরকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন। এছাড়াও তিনি পলাশীর যুদ্ধে তার সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন। সিরাজের বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে কম সংখ্যক সৈন্য নিয়েও তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ক্লাইভের এই কূটনৈতিক এবং সামরিক দক্ষতা পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬. ইংরেজদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র:

পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র তাদের জয়লাভে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ইংরেজদের কামান এবং বন্দুকের গোলাবর্ষণ সিরাজের সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, সিরাজের সৈন্যরা পুরনো ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল, যা ইংরেজদের অস্ত্রের সামনে অকার্যকর প্রমাণিত হয়। এই সামরিক প্রযুক্তির পার্থক্য পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৭. ফরাসিদের নিষ্ক্রিয়তা:

পলাশীর যুদ্ধের সময় ফরাসিরা বাংলায় উপস্থিত ছিল। তাদের সঙ্গে ইংরেজদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। সিরাজ ফরাসিদের সাহায্য চেয়েছিলেন, কিন্তু ফরাসিরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। ফরাসিদের এই নিষ্ক্রিয়তা ইংরেজদের জন্য সুবিধাজনক হয়ে ওঠে এবং পলাশীর যুদ্ধে তাদের জয়লাভকে সহজ করে তোলে।

৮. মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা:

মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। নবাবের সেনাপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেন এবং যুদ্ধের সময় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সিরাজের সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের মনোবল ভেঙে যায়। ইংরেজরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সহজেই যুদ্ধে জয়লাভ করে। মীর জাফরের এই বিশ্বাসঘাতকতা বাংলার ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে স্থান পেয়েছে।

৯. সিরাজ-উদ-দৌলার সামরিক কৌশলের ত্রুটি:

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৌশলগত ভুল করেছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি তার সৈন্যদের মনোবল ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার পর তার সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এছাড়াও, তিনি ইংরেজদের কামান এবং বন্দুকের গোলাবর্ষণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেননি। এই সামরিক কৌশলের ত্রুটিগুলো পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে।

১০. ভাগ্যের পরিহাস:

পলাশীর যুদ্ধে ভাগ্য সিরাজ-উদ-দৌলার প্রতি বিমুখ ছিল। যুদ্ধের সময় প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় সিরাজের সৈন্যদের বারুদের ভিজে যায় এবং তাদের অস্ত্র অকেজো হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, ইংরেজরা তাদের বারুদকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখায় তাদের অস্ত্র সচল ছিল। এই ভাগ্যের পরিহাস পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়কে নিশ্চিত করে।

১১. সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণ:

সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণগুলোও পলাশীর যুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিল। বাংলায় তখন জমিদার এবং ধনী ব্যবসায়ীদের একটি শক্তিশালী শ্রেণী ছিল, যারা সিরাজের কঠোর নীতির কারণে অসন্তুষ্ট ছিল। তারা ইংরেজদেরকে সমর্থন করেছিল কারণ তারা বিশ্বাস করত যে ইংরেজ শাসনে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষ পলাশীর যুদ্ধের একটি অন্যতম পটভূমি হিসেবে কাজ করেছিল।

১২. সিরাজের স্বৈরাচারী শাসন:

সিরাজ-উদ-দৌলার স্বৈরাচারী শাসন এবং অত্যাচারী প্রকৃতি তার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি করে। তার নিষ্ঠুর শাসনব্যবস্থা এবং অবাধ হত্যাযজ্ঞ সাধারণ মানুষের মধ্যে তাকে অজনপ্রিয় করে তোলে। এই অসন্তোষের ফলে তার প্রতি জনগণের সমর্থন কমে যায় এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার জনসমর্থনের অভাব দেখা দেয়।

১৩. ইংরেজদের প্রতি জনগণের উদাসীনতা:

বাংলার সাধারণ মানুষ ইংরেজদের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ বা বিরোধিতা প্রকাশ করেনি। তারা মূলত নিজেদের জীবনযাপন নিয়ে ব্যস্ত ছিল এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে উদাসীন ছিল। এই উদাসীনতা ইংরেজদের জন্য সুবিধাজনক হয়ে ওঠে এবং তাদের বাংলা দখলের পথ সহজ করে দেয়।

১৪. নবাবের সেনাবাহিনীর দুর্বলতা:

সিরাজ-উদ-দৌলার সেনাবাহিনী সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল। সেনাপতি মীর জাফর এবং অন্যান্য অসন্তুষ্ট সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতা সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। এছাড়াও, সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ছিল পুরনো এবং অপ্রচলিত। এই সামরিক দুর্বলতা পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে।

১৫. সামগ্রিক পরিস্থিতি:

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, পলাশীর যুদ্ধের কারণ ছিল বহুমাত্রিক এবং জটিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক উচ্চাভিলাষ, বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, সিরাজ-উদ-দৌলার ইংরেজদের প্রতি বিরূপ মনোভাব, কলকাতার ‘ব্ল্যাক হোল’ ট্র্যাজেডি, রবার্ট ক্লাইভের কূটনৈতিক এবং সামরিক দক্ষতা, ইংরেজদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র, ফরাসিদের নিষ্ক্রিয়তা, মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা, সিরাজের সামরিক কৌশলের ত্রুটি, ভাগ্যের পরিহাস, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণ, সিরাজের স্বৈরাচারী শাসন, ইংরেজদের প্রতি জনগণের উদাসীনতা, নবাবের সেনাবাহিনীর দুর্বলতা – এই সব কারণের সমন্বয়ে পলাশীর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

উপসংহার:

পলাশীর যুদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা। এই যুদ্ধের ফলাফল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা করে। এই যুদ্ধের কারণগুলোর বিশ্লেষণ আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর পেছনের জটিলতা এবং বহুমাত্রিকতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। এই বিশ্লেষণ আমাদের বর্তমান সমাজ এবং রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করে।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *