Skip to main content

ভূমিকা

ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম রাজনীতির বিকাশ একটি দীর্ঘ এবং বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। এর সূচনা হয় মূলত ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর থেকে এবং ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে এর চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। এই সময়কালে, ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয় রক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ধারার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ব্রিটিশ সরকারের নীতি, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে সম্পর্ক এবং মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরীণ সংস্কার আন্দোলন—এই তিনটি নিয়ামক মুসলিম রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে।

প্রাথমিকভাবে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতো নেতারা ব্রিটিশদের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে মুসলিমদের শিক্ষাগত ও সামাজিক উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডে মুসলিমদের স্বার্থ প্রতিফলিত না হওয়ার আশঙ্কা থেকে একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়, যার নাম নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। সময়ের সাথে সাথে, বঙ্গভঙ্গ, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি, খিলাফত আন্দোলন, এবং সাংবিধানিক সংস্কারের বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলিমদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা আরও সুস্পষ্ট হতে থাকে। অবশেষে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপিত হয়, যা উপমহাদেশের বিভক্তির মাধ্যমে সমাপ্তি লাভ করে।

মুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষের কারণ

ব্রিটিশ ভারতে মুসলিমদের মধ্যে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এর পেছনে বিভিন্ন ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান ছিল, যা মুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় ও স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।

১. ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার এর জন্য মূলত মুসলিমদের দায়ী করে। কারণ, বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর এবং অনেক মুসলিম নেতা এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এর ফলে, ব্রিটিশদের রোষানলে পড়ে মুসলিমরা শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। এই বৈষম্যমূলক আচরণ এবং হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা মুসলিমদের মধ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক চেতলার জন্ম দেয়।

২. স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সংস্কার আন্দোলন

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতা দূর করতে এগিয়ে আসেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটিশদের বিরোধিতা না করে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ এবং সরকারের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমেই মুসলিমদের উন্নতি সম্ভব। এই লক্ষ্যে তিনি আলীগড় আন্দোলন শুরু করেন এবং ১৮৭৫ সালে মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ (পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল একটি শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করা, যারা নিজেদের অধিকার ও স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হবে। প্রাথমিকভাবে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে বিশ্বাসী হলেও পরবর্তীতে কংগ্রেসের কিছু কর্মকাণ্ডে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে মুসলিমদের স্বার্থ উপেক্ষিত হতে পারে। তাই তিনি মুসলিমদের কংগ্রেসে যোগদান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন, যা একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ধারার সূচনা করে।

৩. কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ও মুসলিমদের সংশয়

১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক মুসলিম নেতা একে স্বাগত জানান। কিন্তু ধীরে ধীরে কংগ্রেসের বিভিন্ন নীতি ও কর্মকাণ্ডে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "বন্দেমাতরম" সংগীত, শিবাজী উৎসব এবং গো-রক্ষা আন্দোলনের মতো বিষয়গুলো মুসলিমদের মধ্যে সংশয় ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। তাদের মনে হতে থাকে যে, কংগ্রেস মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতো নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, কংগ্রেসের দাবি অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরাই শাসন ক্ষমতায় থাকবে, যা মুসলিমদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বিপন্ন করতে পারে।

৪. বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ও এর প্রতিক্রিয়া

১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার্থে বাংলাকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এই বিভক্তির ফলে "পূর্ববঙ্গ ও আসাম" নামে একটি নতুন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গঠিত হয়। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহসহ অনেক মুসলিম নেতা বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানান, কারণ তারা মনে করেছিলেন যে নতুন প্রদেশে মুসলিমরা শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ পাবে।

কিন্তু কংগ্রেস এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা শুরু করে এবং এর বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের চাপ এবং আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে। এই ঘটনাটি মুসলিম নেতাদের গভীরভাবে হতাশ করে। তারা উপলব্ধি করেন যে, একটি সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা আদায় বা রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই উপলব্ধিই একটি সর্বভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনের পথ প্রশস্ত করে।

মুসলিম রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ: মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা

বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর মুসলিম নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা।

১. সিমলা ডেপুটেশন (১৯০৬)

শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের আভাস পেয়ে মুসলিম নেতারা তাদের দাবি-দাওয়া ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর, আগা খানের নেতৃত্বে ৩৫ জন প্রভাবশালী মুসলিম নেতার একটি প্রতিনিধি দল সিমলায় ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ সিমলা ডেপুটেশন নামে পরিচিত। প্রতিনিধি দলটি ভাইসরয়ের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে, যেখানে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী এবং জনসংখ্যানুপাতের চেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্বের দাবি জানানো হয়। লর্ড মিন্টো তাদের দাবিগুলো সহানুভূতির সাথে বিবেচনার আশ্বাস দেন, যা মুসলিম নেতাদের দারুণভাবে উৎসাহিত করে।

২. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা (১৯০৬)

সিমলা ডেপুটেশনের সাফল্য মুসলিম নেতাদের একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সংগঠন গড়তে অনুপ্রাণিত করে। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত "সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন" শেষে একটি রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় নবাব ভিকার-উল-মুলকের সভাপতিত্বে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়।

মুসলিম লীগ গঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল:

  • ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় মুসলিমদের আনুগত্য বৃদ্ধি করা।
  • মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে উপস্থাপন করা।
  • অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি মুসলিমদের মধ্যে বিদ্বেষ যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা।

৩. পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি আদায় (১৯০৯)

মুসলিম লীগের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি আদায়। ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন প্রবর্তন করে। এই আইনে মুসলিম লীগের দাবি মেনে নিয়ে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে মুসলিম ভোটাররা শুধুমাত্র মুসলিম প্রার্থীদেরই ভোট দেওয়ার অধিকার লাভ করে, যা তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এই ব্যবস্থাটি মুসলিম রাজনীতিকে একটি নতুন এবং শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে এবং পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

মুসলিম রাজনীতির গতি পরিবর্তন ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের নীতি থেকে সরে এসে মুসলিম লীগ ধীরে ধীরে স্বায়ত্তশাসন এবং কংগ্রেসের সাথে সহযোগিতার পথে অগ্রসর হয়।

১. বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১) ও মুসলিমদের মোহভঙ্গ

১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের চাপের মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ করার ঘোষণা দেয়। এই ঘটনাটি মুসলিম নেতাদের জন্য একটি বড় আঘাত ছিল। তারা বঙ্গভঙ্গকে মুসলিমদের অগ্রগতির একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিল এবং ব্রিটিশদের আশ্বাসের উপর আস্থা রেখেছিল। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় তারা অনুভব করে যে, ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থে যেকোনো সময় তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারে। এই মোহভঙ্গের ফলে মুসলিম লীগের তরুণ নেতারা, বিশেষ করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো ব্যক্তিত্বরা, ব্রিটিশদের উপর নির্ভরশীলতার নীতি পরিহার করে স্বায়ত্তশাসনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন।

২. লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬)

মুসলিম লীগের রাজনীতিতে পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন ঘটে ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে। এই চুক্তিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ সরকারের কাছে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি জানায়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যিনি তখন কংগ্রেস ও লীগ উভয় দলেরই সদস্য ছিলেন, এই চুক্তির পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেন।

এই চুক্তির প্রধান দুটি দিক ছিল:

  • কংগ্রেস মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি মেনে নেয়।
  • মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সাথে இணைந்து ভারতের জন্য স্বায়ত্তশাসনের (Dominion Status) দাবি জানায়।

লক্ষ্ণৌ চুক্তি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এবং এটি প্রমাণ করে যে, উভয় সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারে।

৩. খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার এবং তার মিত্ররা তুরস্কের ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলে ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, তুরস্কের সুলতানকে তারা মুসলিম বিশ্বের খলিফা বা ধর্মীয় নেতা হিসেবে মানত। খলিফার মর্যাদা রক্ষার জন্য ভারতে মাওলানা মোহাম্মদ আলীমাওলানা শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়।

একই সময়ে, রাওলাট আইন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। গান্ধী খিলাফত আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে একীভূত করেন, যার ফলে হিন্দু ও মুসলিমরা প্রথমবারের মতো একটি ব্যাপক গণআন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এই আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দেয়। যদিও ১৯২৪ সালে তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক খিলাফত বিলুপ্ত করলে এবং চৌরিচৌরার ঘটনার পর গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে এই ঐক্য ভেঙে যায়। আন্দোলনের ব্যর্থতা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও তিক্ততা সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী রাজনীতিকে প্রভাবিত করে।

পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দিকে মুসলিম রাজনীতি

খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতির পর মুসলিম রাজনীতির গতিপথ পুনরায় পরিবর্তিত হয়। সাংবিধানিক অধিকার ও সুরক্ষার দাবি ধীরে ধীরে একটি পৃথক রাষ্ট্রের ধারণার দিকে মোড় নিতে থাকে। এই পর্যায়ে বেশ কিছু ঘটনা ও প্রস্তাব মুসলিমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির ভাবনাকে শক্তিশালী করে তোলে।

১. নেহেরু রিপোর্ট (১৯২৮) ও জিন্নাহর চৌদ্দ দফা (১৯২৯)

ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে একটি কমিটি নেহেরু রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে মুসলিমদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি বাতিল করে তার পরিবর্তে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও, কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিমদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের দাবিও অগ্রাহ্য করা হয়। এই রিপোর্ট মুসলিম লীগকে গভীরভাবে হতাশ করে।

এর জবাবে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯২৯ সালে মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তার বিখ্যাত চৌদ্দ দফা দাবি পেশ করেন। এই দফাগুলোতে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল রাখা, প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিমদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। নেহেরু রিপোর্টের প্রত্যাখ্যান এবং জিন্নাহর চৌদ্দ দফা পেশের মাধ্যমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে দূরত্ব চূড়ান্তভাবে বৃদ্ধি পায়।

২. আল্লামা ইকবালের ভাষণ (১৯৩০)

মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করেন প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক স্যার মুহাম্মদ ইকবাল। ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি সর্বপ্রথম ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের ধারণা দেন। তিনি বলেন, "আমি দেখতে চাই পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান একটি একক রাষ্ট্রে একীভূত হোক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভেতরে বা বাইরে, একটি স্ব-শাসিত উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্রই আমার কাছে মুসলিমদের, অন্তত উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিমদের, চূড়ান্ত নিয়তি বলে মনে হয়।" যদিও এটি তখন একটি অস্পষ্ট ধারণা ছিল, ইকবালের এই ভাষণ মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিকাশে এবং পৃথক রাষ্ট্রের স্বপ্ন তৈরিতে গভীর প্রভাব ফেলে।

৩. ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও কংগ্রেসী শাসন

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে কংগ্রেস ব্যাপক বিজয় লাভ করে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসহ সাতটি প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করে। মুসলিম লীগ নির্বাচনে আশানুরূপ ফল করতে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনের পর কংগ্রেস মুসলিম লীগকে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোতে বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দেমাতরম' সংগীতকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া, হিন্দি ভাষার প্রচলন এবং কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলনের মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ মুসলিমদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা অভিযোগ করে যে, কংগ্রেসী শাসন প্রকৃতপক্ষে হিন্দু শাসনের নামান্তর এবং এর অধীনে তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় নিরাপদ নয়। এই অভিজ্ঞতা মুসলিমদের মধ্যে পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার অনুভূতিকে আরও শক্তিশালী করে এবং মুসলিম লীগকে সাধারণ মুসলিমদের কাছাকাছি নিয়ে আসে।

চূড়ান্ত পর্যায়: পাকিস্তান আন্দোলন

১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং পরবর্তী দুই বছরের শাসন অভিজ্ঞতা মুসলিমদের মধ্যে এই ধারণাকে বদ্ধমূল করে যে, অখণ্ড ভারতে তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। এই প্রেক্ষাপটে, মুসলিম রাজনীতি একটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে চূড়ান্ত রূপ নেয়, যা পাকিস্তান আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে।

১. লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০)

পৃথক রাষ্ট্রের দাবিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি ছিল লাহোর প্রস্তাব। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ, লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এই ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন।

প্রস্তাবে বলা হয়, "ভৌগোলিকভাবে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ (Independent States) গঠন করা যায়, যেখানে অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।"

এই প্রস্তাবটিই পরবর্তীকালে "পাকিস্তান প্রস্তাব" নামে খ্যাতি লাভ করে এবং এটি ছিল মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি আদায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। এরপর থেকে মুসলিম লীগের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা।

২. ক্রিপস মিশন (১৯৪২) ও ক্যাবিনেট মিশন (১৯৪৬)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয়দের সমর্থন আদায়ের জন্য ব্রিটিশ সরকার বেশ কিছু সাংবিধানিক প্রস্তাব নিয়ে আসে। ১৯৪২ সালে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে, যা প্রদেশগুলোকে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার প্রদান করে, যা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের দাবিকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

যুদ্ধ শেষে, ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ক্যাবিনেট মিশন প্রেরণ করে। এই মিশন ভারতকে অখণ্ড রেখে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রস্তাব করে, যেখানে প্রদেশগুলোকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করার কথা বলা হয়, যার মধ্যে দুটি গ্রুপ ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলিম লীগ প্রথমে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও কংগ্রেসের আপত্তির কারণে পরবর্তীতে তা থেকে সরে আসে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' ঘোষণা করে। এর ফলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারত বিভাগকে অনিবার্য করে তোলে।

৩. ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আইন ও ভারত বিভাগ

ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, ব্রিটিশ সরকার ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন, যা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ পাস করে।

এই আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ই আগস্ট ভারত নামে দুটি স্বাধীন ডোমিনিয়ন রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর মাধ্যমে উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির প্রায় এক শতাব্দীর পরিক্রমার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে, যা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ভূগোলকে চিরতরে পরিবর্তন করে দেয়।

উপসংহার

ব্রিটিশ শাসিত উপমহাদেশে মুসলিম রাজনীতির বিকাশ ছিল একটি ধারাবাহিক ও বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর মুসলিমদের পশ্চাৎপদতা এবং আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সংস্কার আন্দোলন মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি স্থাপন করে। পরবর্তীতে, কংগ্রেসের নীতি এবং কর্মকাণ্ডে মুসলিম স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা মুসলিমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে।

পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি আদায় থেকে শুরু করে লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামে অংশগ্রহণ এবং খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা—প্রতিটি ঘটনাই মুসলিম রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে। তবে, নেহেরু রিপোর্ট, ১৯৩৭ সালের কংগ্রেসী শাসন এবং ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিভেদ মুসলিম নেতৃত্বকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করে যে, অখণ্ড ভারতে তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। এই উপলব্ধি থেকেই আল্লামা ইকবালের দার্শনিক চিন্তা এবং জিন্নাহর নেতৃত্বে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপিত হয়। অবশেষে, দীর্ঘ সংগ্রাম ও আলোচনার পর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী

কোনো পূর্ববর্তী পোস্ট নেই

পরবর্তী

খিলাফত আন্দোলনের কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা কর।

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

তিতুমীরের বিদ্রোহ ছিল বাংলার প্রথম কৃষক বিদ্রোহ - আলোচনা কর।

উনিশ শতকের বাংলায় তিতুমীরের নেতৃত্বে সংঘটিত বারাসাত বিদ্রোহকে প্রায়শই বাংলার প্রথম সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট, কারণ, প্রকৃতি, এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর সত্যতা যাচাই করা যায়। জমিদার, নীলকর এবং ব্রিটিশ শাসনের тройной শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ কৃষকদের সংগঠিত প্রতিরোধ হিসেবে তিতুমীরের এই সংগ্রাম বাংলার ইতিহাসে এক অনবদ্য স্থান অধিকার করে আছে। ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও, এটি দ্রুতই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মাত্রা লাভ করে এবং শোষিত কৃষকদের অধিকার আদায়ের এক শক্তিশালী প্রয়াসে পরিণত হয়।

পড়ুন

পলাশী যুদ্ধের ফলাফল ও তৎপরবর্তী আলোচনা কর।

১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং নবাবী শাসনের অবসান ঘটে। এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ছিল ব্যাপক, যা ভারতীয় উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।

পড়ুন