সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী (বাকশাল) এবং দ্বাদশ সংশোধনী (সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন)- এই দুটি সংশোধনীর প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর উপর এদের বিপরীতমুখী প্রভাব বিস্তারিতভাবে মূল্যায়ন কর।
ভূমিকা
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এমন কিছু সংশোধনী রয়েছে যা দেশের রাজনৈতিক গতিপথকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছে। এর মধ্যে সংবিধানের চতুর্থ এবং দ্বাদশ সংশোধনী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দুটি সংশোধনী কেবল আইনগত পরিবর্তন ছিল না, বরং ছিল দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক দর্শন ও শাসনব্যবস্থার প্রতিফলন।
১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি গৃহীত চতুর্থ সংশোধনী বাংলাদেশকে সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি-শাসিত একদলীয় শাসনব্যবস্থায় (বাকশাল) রূপান্তরিত করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে বিলুপ্ত করা হয়। অন্যদিকে, ১৯৯১ সালের ৬ই আগস্ট গৃহীত দ্বাদশ সংশোধনী স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশকে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনে।
সুতরাং, চতুর্থ এবং দ্বাদশ সংশোধনী বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর দুটি বিপরীতমুখী প্রভাব ফেলেছিল। একটি গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছিল, অন্যটি গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিল। এই দুটি সংশোধনীর প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য এবং দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর তাদের সুদূরপ্রসারী প্রভাব মূল্যায়ন করা বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস অনুধাবনের জন্য অপরিহার্য।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী (বাকশাল)
১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়, যা দেশের শাসনব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী ও বিতর্কিত পরিবর্তন সাধন করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়, যা বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) নামে পরিচিতি লাভ করে।
প্রেক্ষাপট ও কারণ
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে நிலவும் অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে চতুর্থ সংশোধনী আনার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তৎকালীন সরকার যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- অর্থনৈতিক সংকট: ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল।
- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। চরমপন্থী দলগুলোর সহিংস কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: সরকারবিরোধী দল, বিশেষ করে জাসদ ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোর সশস্ত্র তৎপরতা একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
- প্রশাসনিক দুর্বলতা: নতুন রাষ্ট্রে প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল ছিল এবং দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে, স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য একটি "দ্বিতীয় বিপ্লব"-এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়, যার সাংবিধানিক রূপ ছিল চতুর্থ সংশোধনী।
উদ্দেশ্য
চতুর্থ সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্যগুলো ছিল:
- শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করা: একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা।
- অর্থনৈতিক মুক্তি: কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতি বাস্তবায়ন করা।
- জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা: সকল দল ও মতকে একটি জাতীয় দলের অধীনে এনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা।
- দুর্নীতি ও দুঃশাসন দমন: কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে দুর্নীতি, চোরাচালান এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা দমন করা।
মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আনা প্রধান পরিবর্তনগুলো হলো:
১. রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন: সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। ২. একদলীয় শাসন (বাকশাল): দেশের সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে "বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ" (বাকশাল) নামে একটি মাত্র জাতীয় দল গঠন করা হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও এই দলের সদস্য হওয়ার সুযোগ রাখা হয়। ৩. বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব: বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়। বিচারক নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়, যা বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ৪. মৌলিক অধিকার স্থগিত: এই সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের কতিপয় মৌলিক অধিকার প্রয়োগের এখতিয়ার সীমিত করা হয়। ৫. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ: চারটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংবাদপত্র ছাড়া বাকি সব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৬. সংসদের ক্ষমতা হ্রাস: জাতীয় সংসদের ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করা হয় এবং এটিকে একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়।
রাজনৈতিক কাঠামোর উপর প্রভাব
চতুর্থ সংশোধনীর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী এবং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়:
- গণতন্ত্রের বিলুপ্তি: বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামো তৈরি হয়।
- ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়। আইন, নির্বাহী ও বিচার—তিনটি বিভাগই এক ব্যক্তির অধীনে চলে যায়।
- রাজনৈতিক শূন্যতা: বিরোধী দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে দেশের জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে আনে।
- নাগরিক অধিকার সংকোচন: জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের অধিকার এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার খর্ব হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও পরবর্তী সময়ে এক পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে যে, ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী ছিল।
সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (সংসদীয় গণতন্ত্র)
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাংবিধানিক রূপ দিতে ১৯৯১ সালের ৬ই আগস্ট জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছর পর দেশ পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করে।
প্রেক্ষাপট ও কারণ
দ্বাদশ সংশোধনী আনার পেছনে প্রধান কারণগুলো ছিল:
- ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান: স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
- তিন জোটের রূপরেখা: আন্দোলনরত প্রধান তিনটি জোট (৮-দল, ৭-দল ও ৫-দল) একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি অভিন্ন রূপরেখায় একমত হয়েছিল।
- বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: এরশাদের পতনের পর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তার প্রধান দায়িত্ব ছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
- গণরায়: ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে জনগণ সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে রায় দেয়, কারণ প্রধান দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে এই প্রতিশ্রুতি ছিল।
উদ্দেশ্য
দ্বাদশ সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল:
- সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা: ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের চেতনায় ফিরে গিয়ে রাষ্ট্রপতি-শাসিত ব্যবস্থার পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত বা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা।
- রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাস: রাষ্ট্রপতির পদকে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক প্রধান হিসেবে রেখে প্রকৃত নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত করা।
- সংসদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা: জাতীয় সংসদকে সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
- গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন: একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর আইনি ভিত্তি তৈরি করা।
মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়:
১. সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন: রাষ্ট্রপতি-শাসিত ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে পুনরায় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। ২. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাহী ক্ষমতা: রাষ্ট্রের প্রকৃত নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার ওপর অর্পণ করা হয়। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য থাকেন (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। ৩. মন্ত্রিসভার দায়বদ্ধতা: মন্ত্রিসভা তাদের কাজের জন্য যৌথভাবে জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী থাকবে বলে বিধান করা হয়। ৪. রাষ্ট্রপতির নামসর্বস্ব ভূমিকা: রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান হন, কিন্তু তার ক্ষমতা সীমিত করা হয়। তিনি সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। ৫. উপ-রাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্তি: রাষ্ট্রপতি-শাসিত ব্যবস্থার সহযোগী পদ হিসেবে উপ-রাষ্ট্রপতির পদটি বিলুপ্ত করা হয়।
রাজনৈতিক কাঠামোর উপর প্রভাব
দ্বাদশ সংশোধনী বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে নিম্নলিখিত ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে:
- গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম: এই সংশোধনী স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করে।
- জবাবদিহিমূলক সরকার: সরকার সংসদের কাছে দায়ী থাকায় একটি জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়।
- রাজনৈতিক বহুত্ববাদের বিকাশ: বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি প্রাণবন্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
- সংসদের প্রাধান্য: আইন প্রণয়ন এবং সরকারের কার্যক্রম তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ কেন্দ্রীয় ভূমিকা লাভ করে।
তবে, দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে এলেও, এর প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতাও পরিলক্ষিত হয়, যেমন—সংসদীয় কার্যক্রমে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা।
চতুর্থ ও দ্বাদশ সংশোধনীর বিপরীতমুখী প্রভাবের মূল্যায়ন
চতুর্থ এবং দ্বাদশ সংশোধনী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাসে দুটি ভিন্ন মেরুর প্রতিনিধিত্ব করে। এদের প্রভাব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। একটি যেখানে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছে, অন্যটি সেখানে ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীভূত করে গণতন্ত্রকে প্রসারিত করেছে।
শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন
- চতুর্থ সংশোধনী: এই সংশোধনী সংসদীয় পদ্ধতিকে বাতিল করে রাষ্ট্রপতি-শাসিত একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে। যেখানে নির্বাহী ক্ষমতা এক ব্যক্তির (রাষ্ট্রপতি) হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল।
- দ্বাদশ সংশোধনী: এর বিপরীতে, দ্বাদশ সংশোধনী রাষ্ট্রপতি-শাসিত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। যেখানে নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত থাকে এবং তারা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে।
ক্ষমতা ও জবাবদিহিতার কাঠামো
- চতুর্থ সংশোধনী: ক্ষমতার কোনো পৃথকীকরণ বা ভারসাম্য ছিল না। রাষ্ট্রপতি একাধারে নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং বিচার বিভাগের ওপরও তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। কোনো কার্যকর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা ছিল না।
- দ্বাদশ সংশোধনী: এই সংশোধনী ক্ষমতার পৃথকীকরণের নীতিকে পুনরায় स्थापित করে। নির্বাহী বিভাগ (মন্ত্রিসভা) আইন বিভাগের (সংসদ) কাছে দায়বদ্ধ থাকে। এটি একটি জবাবদিহিমূলক সরকারের কাঠামো তৈরি করে।
রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
- চতুর্থ সংশোধনী: বহুদলীয় রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে একদলীয় (বাকশাল) ব্যবস্থা চালু করা হয়। এটি রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে ধ্বংস করে এবং ভিন্নমতকে দমন করে।
- দ্বাদশ সংশোধনী: একদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃস্থাপন করা হয়। এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিকাশ এবং সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করে।
মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
- চতুর্থ সংশোধনী: নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ব্যাপকভাবে সংকুচিত করা হয় এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে নির্বাহী বিভাগের অধীনে নিয়ে আসা হয়।
- দ্বাদশ সংশোধনী: যদিও দ্বাদশ সংশোধনী সরাসরি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বড় কোনো পরিবর্তন আনেনি, তবে গণতান্ত্রিক পরিবেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। এটি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারের পথ খুলে দেয়।
এই মূল্যায়ন থেকে স্পষ্ট যে, চতুর্থ সংশোধনী ছিল গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে একটি পশ্চাদপসরণ, যা বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, দ্বাদশ সংশোধনী ছিল স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যা দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে একটি গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিবর্তনের ইতিহাসে চতুর্থ ও দ্বাদশ সংশোধনী দুটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, যাদের দর্শন ও ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী দেশের নবীন গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে একটি একদলীয়, রাষ্ট্রপতি-শাসিত কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল। এর মাধ্যমে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ বিলুপ্ত হয় এবং নাগরিক অধিকার খর্ব হয়, যা দেশকে একটি অন্ধকার যুগে ঠেলে দেয়।
বিপরীতে, দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনী ছিল গণতন্ত্রের পথে এক বিজয়ী প্রত্যাবর্তন। এটি গণ-আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষাকে সাংবিধানিক রূপ দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র, বহুদলীয় রাজনীতি এবং সরকারের জবাবদিহিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। যদিও এই ব্যবস্থার প্রায়োগিক দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে, তবুও এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
বস্তুত, এই দুটি সংশোধনী হলো গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের মধ্যকার চিরন্তন দ্বন্দ্বের এক মূর্ত প্রতীক। চতুর্থ সংশোধনী যেমন একটি বিচ্যুতি হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, তেমনি দ্বাদশ সংশোধনী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে আজও প্রাসঙ্গিক।
The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।
ছয় দফা কর্মসূচির দফাগুলো উল্লেখপূর্বক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি রচনায় এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য মূল্যায়ন কর।
সম্পর্কিত পোস্ট
একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের (৫ম থেকে ১১শ) প্রেক্ষাপট, ফলাফল এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য পৃথকভাবে বিশ্লেষণ কর।
১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ৫ম থেকে ১১শ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট, ফলাফল ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনের ঐতিহাসিক পটভূমি, প্রধান দলগুলোর আসন সংখ্যা, ভোটের হার এবং গণতন্ত্রের উপর এর প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে।