Skip to main content

ছয় দফা কর্মসূচির দফাগুলো উল্লেখপূর্বক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি রচনায় এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য মূল্যায়ন কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ও দিকনির্দেশনামূলক ঘটনা। এটি ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং সামরিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ও বাঙালির অধিকার আদায়ের এক সুস্পষ্ট রূপরেখা। ছয় দফাকে প্রায়শই বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’ বা ‘ম্যাগনা কার্টা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে এমন এক রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করান, যা পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে ছয় দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।

ছয় দফা কর্মসূচির দফাগুলো

১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম এই ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন। যদিও সম্মেলন কর্তৃপক্ষ এটি প্রত্যাখ্যান করে, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এটি গৃহীত হয় এবং দেশব্যাপী এর পক্ষে ব্যাপক জনমত গঠিত হয়। "আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি" শিরোনামে প্রকাশিত পুস্তিকায় দফাগুলো সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। দফাগুলো ছিল নিম্নরূপ:

১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। এর সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির। প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভোটে আইনসভা গঠিত হবে এবং আইনসভার সার্বভৌমত্ব থাকবে।

২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা

কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকারের হাতে কেবলমাত্র দুটি বিষয় থাকবে—প্রতিরক্ষাপররাষ্ট্রনীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

৩. মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা

মুদ্রা বিষয়ে দুটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল:

  • ক) সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
  • খ) অথবা, যদি একটি মুদ্রা চালু থাকে, তবে সংবিধানে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মূলধন পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। এক্ষেত্রে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

৪. রাজস্ব, কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা

সকল প্রকার কর ও শুল্ক ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হবে।

৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা

  • ফেডারেশনের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা নিজ নিজ অঙ্গরাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
  • কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা উভয় অঙ্গরাজ্য সমানভাবে অথবা নির্ধারিত অনুপাতে প্রদান করবে।
  • অঙ্গরাজ্যগুলো বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি ও আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার রাখবে।

৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা

আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য অঙ্গরাজ্যগুলোকে নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে আধা-সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি রচনায় ছয় দফার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ছয় দফা কর্মসূচি কেবল কিছু দাবির সমষ্টি ছিল না, এটি ছিল বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার এক শক্তিশালী রাজনৈতিক দর্শন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি রচনায় এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিম্নোক্তভাবে মূল্যায়ন করা যায়:

১. বাঙালির ‘মুক্তিসনদ’ হিসেবে স্বীকৃতি

ছয় দফা দাবি ছিল মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের নাগপাশ থেকে বাঙালির মুক্তির এক সুস্পষ্ট সনদ। দীর্ঘ দুই দশকের বৈষম্যের শিকার বাঙালি জাতি এই কর্মসূচির মধ্যে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে পায়। এটি প্রথমবারের মতো বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিগুলোকে একটি সুসংহত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে, যা সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।

২. বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশ

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটালেও ছয় দফা আন্দোলন তাকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাঙালি জাতি—ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, কৃষকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ—ঐক্যবদ্ধ হয়। "তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা" কিংবা "জাগো জাগো, বাঙালি জাগো"—এসব স্লোগান দিয়ে ছয় দফার পক্ষে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এক অনবদ্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

৩. স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান

এর আগে স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত হলেও তা ছিল অস্পষ্ট ও বিক্ষিপ্ত। ছয় দফা কর্মসূচি প্রথমবারের মতো স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে একটি সুনির্দিষ্ট, নিয়মতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক রূপরেখা প্রদান করে। এর প্রতিটি দফা ছিল নিয়মতান্ত্রিক এবং আইনানুগ, যা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা কঠিন ছিল।

৪. আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উত্থান

ছয় দফা কর্মসূচি আওয়ামী লীগকে বাংলার একক রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই কর্মসূচির মাধ্যমে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। দেশব্যাপী ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠন করতে গিয়ে তিনি বারবার কারাবরণ করেন, যা তার জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং আওয়ামী লীগকে জনগণের আস্থার প্রতীকে পরিণত করে।

৫. শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

ছয় দফার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফার সমর্থনে ডাকা হরতালে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে মনু মিয়াসহ ১১ জন শহীদ হন। এই হত্যাকাণ্ড আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলা ছয় দফার আন্দোলনকে দমাতে পারেনি, বরং এর প্রতিক্রিয়ায় যে তীব্র গণআন্দোলন শুরু হয় তা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ তৈরি করে।

৬. ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং সরকারি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের ১১ দফা এবং আওয়ামী লীগের ছয় দফা একীভূত হয়ে ১৯৬৯ সালে এক সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দেয়। এই গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে এবং বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এই মুক্তি ছিল ছয় দফা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক বিরাট বিজয়।

৭. ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ম্যান্ডেট

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল কার্যত ছয় দফার পক্ষে এক গণভোট। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি (সংরক্ষিত নারী আসনসহ) এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৮৮টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই বিপুল বিজয় প্রমাণ করে যে, ছয় দফার প্রতি বাঙালি জাতির পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং এর ভিত্তিতেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে হবে।

৮. স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে চূড়ান্ত ধাপ

নির্বাচনে জয়লাভের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে, তখন ছয় দফার দাবি বাস্তবায়নের আর কোনো সাংবিধানিক পথ খোলা ছিল না। নির্বাচনী রায়কে উপেক্ষা করার ফলস্বরূপ বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ছয় দফার স্বায়ত্তশাসনের দাবি এভাবেই এক দফায়, অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়।

উপসংহার

ছয় দফা কর্মসূচি ছিল একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য ছিল শোষণ ও বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এটি বাঙালি জাতিকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছে, জাতীয়তাবাদের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে এই কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন, যা প্রথমে স্বাধিকার এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, ছয় দফা কর্মসূচিই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তি এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

পড়ুন

The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা এই লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

পড়ুন