Skip to main content

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের সংকট, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পুনরায় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের একটি চক্র— উক্তিটির আলোকে ১৯৭৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান-পতনের একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে সংসদীয় গণতন্ত্রের সংকট, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পুনরায় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের একটি চক্র হিসেবে বর্ণনা করা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয়েছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে ১৯৭৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত, দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন সংকট, উত্থান-পতন ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় সংসদীয় গণতন্ত্র বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে এবং গণ-আন্দোলনের মুখে পুনরায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে এসেছে। তবে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পরেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টেকসই হতে দেয়নি, যা প্রায়শই নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান-পতনের একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ নিচে তুলে ধরা হলো।

সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা ও প্রাথমিক সংকট (১৯৭৩-১৯৭৫)

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এই সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই সরকার তার যাত্রা শুরু করে।

কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সংসদীয় গণতন্ত্রের এই প্রাথমিক পর্যায় মারাত্মক সংকটের মুখে পড়ে। এর পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ বিদ্যমান ছিল:

১. অর্থনৈতিক সংকট ও প্রশাসনিক দুর্বলতা

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা এবং ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সরকারের জনপ্রিয়তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রশাসনিক অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি

স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। বিভিন্ন বামপন্থী উগ্রবাদী দলের সশস্ত্র কার্যকলাপ এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সরকারকে কঠোর হতে বাধ্য করে। এর ফলে, সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করে, যা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য সমালোচিত হয়।

৩. একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন (বাকশাল)

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে এবং একটি স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল করে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এর আওতায় দেশের সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা বাকশাল নামে একটি মাত্র জাতীয় দল গঠন করা হয়। এই পদক্ষেপকে অনেকেই গণতন্ত্রের মৃত্যু বলে অভিহিত করেন, যা তৎকালীন রাজনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করে এবং সামরিক হস্তক্ষেপের পথকে প্রশস্ত করে।

প্রথম সামরিক হস্তক্ষেপ ও শাসন (১৯৭৫-১৯৮১)

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান এবং রাজনৈতিক শূন্যতার প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট একদল সেনা কর্মকর্তার অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথম প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপের সূচনা করে এবং দেশকে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়।

১. অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা গ্রহণ করলেও তার সরকার ছিল ক্ষণস্থায়ী। এরপর ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে। এই অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আবির্ভূত হন।

২. সামরিক শাসনের বৈধতাকরণ

জিয়াউর রহমান প্রথমে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তীতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত সকল সামরিক আইন, বিধি ও আদেশকে সাংবিধানিক বৈধতা দেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতেও পরিবর্তন আনা হয়।

৩. নিয়ন্ত্রিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রচলন

জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের অধীনেই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। তিনি প্রথমে 'জাগদল' এবং পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। তার শাসনামলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ উন্মুক্ত করা হয়। তবে এই গণতন্ত্র ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং সামরিক বাহিনীর প্রভাবমুক্ত ছিল না।

জিয়াউর রহমানের শাসনকাল ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেষ হয়। তার মৃত্যু দেশকে পুনরায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।

গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টা ও দ্বিতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ (১৯৮২-১৯৯০)

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু তার দুর্বল নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।

১. এরশাদের সামরিক শাসন

এরশাদ ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক আইন জারি করেন, সংবিধান স্থগিত করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি প্রায় নয় বছর দেশ শাসন করেন। এই সময়ে তিনি উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ কিছু প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ নেন। রাজনৈতিকভাবে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য তিনি জাতীয় পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের আয়োজন করেন।

২. স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলন

এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮-দলীয় জোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে ৭-দলীয় জোট, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে। ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে জেনারেল এরশাদ ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।

সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নতুন সংকট (১৯৯১-২০০৬)

এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

১. সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন

১৯৯১ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। এই সরকারের সময়ে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

২. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন

গণতন্ত্র ফিরে এলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এই দুই প্রধান দলের মধ্যে চরম রাজনৈতিক বিভেদ ও সংঘাত শুরু হয়। বিশেষ করে, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ক্রমাগত দাবির মুখে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এই ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

৩. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা

এই সময়ে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলেও দুই দলের প্রতিহিংসার রাজনীতি, সংসদ বর্জন, হরতাল এবং রাজনৈতিক সংঘাত দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্ষমতার পালাবদল হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও তৃতীয় হস্তক্ষেপ (২০০৭-২০০৮)

২০০৬ সালের শেষদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট তা প্রত্যাখ্যান করে এবং রাজপথে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। দেশব্যাপী সহিংসতা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করেন।

এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের সমর্থনে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি নতুন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। এ সময় একটি বড় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানো হয় এবং প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতাদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয়বারের মতো পরোক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়, যা গণতন্ত্রের চক্রে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করে।

গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন এবং বর্তমান রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি (২০০৯-বর্তমান)

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল বিজয় লাভ করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে।

১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এই বিলুপ্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন এবং গভীর সংকটের জন্ম দেয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোট এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

২. নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট ও গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি ও তার জোট বর্জন করে। ফলে ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং নির্বাচনটি একটি একতরফা রূপ নেয়। একইভাবে ২০১৮ সালের একাদশ এবং ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বিরোধী দলের অংশগ্রহণ এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই নির্বাচনগুলো দেশের রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করেছে এবং গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি, избирательной ব্যবস্থার ওপর আস্থার অভাব এবং রাজনৈতিক বিভাজন সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।

উপসংহার

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে यह स्पष्ट যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্রের সংকট, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পুনরায় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের একটি পুনরাবৃত্তিমূলক চক্র। ১৯৭৩ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে তা দ্রুতই পথ হারায়, যা ১৯৭৫ সালের সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এরপর জিয়াউর রহমান ও এরশাদের দীর্ঘ দেড় দশকের সামরিক শাসন শেষে ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসে। কিন্তু দুই প্রধান দলের মধ্যকার তীব্র সংঘাত ও অবিশ্বাস গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী হতে দেয়নি, যার ফলশ্রুতিতে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত সরকারের আবির্ভাব ঘটে।

সর্বশেষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি বাংলাদেশকে আবারও একটি গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে, যা থেকে উত্তরণের পথ এখনও অনিশ্চিত। এই চক্র থেকে বেরিয়ে একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

পড়ুন

The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা এই লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

পড়ুন