Skip to main content

১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের (৫ম থেকে ১১শ) প্রেক্ষাপট, ফলাফল এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য পৃথকভাবে বিশ্লেষণ কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের এক নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই পটভূমিতে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একটি মাইলফলক, যা দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে। এরপর থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনগুলো কেবল সরকারের পরিবর্তনই ঘটায়নি, বরং দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। প্রতিটি নির্বাচনের নিজস্ব প্রেক্ষাপট, ফলাফল এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গতিপথ নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃত।

১. প্রেক্ষাপট

  • স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন: দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল।
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন: সকল দলের সম্মতিতে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা।
  • গণতন্ত্রের পথে প্রত্যাবর্তন: এই নির্বাচনকে দেখা হচ্ছিল স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে। জনগণের মধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল।

২. ফলাফল

  • অংশগ্রহণকারী দল: নির্বাচনে ৭৫টি রাজনৈতিক দল এবং ৪২৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ মোট ২,৭৮৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন।
  • ভোটের হার: নির্বাচনে মোট ভোটের হার ছিল ৫৫.৪%।
  • আসন সংখ্যা:
    • বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি): ১৪০টি আসন পেয়ে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
    • বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ: ৮৮টি আসন লাভ করে।
    • জাতীয় পার্টি: ৩৫টি আসন পায়।
    • বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী: ১৮টি আসন লাভ করে।

ফলাফল অনুযায়ী, কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে এবং বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

৩. রাজনৈতিক তাৎপর্য

  • গণতান্ত্রিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা: এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের অবসান ঘটে এবং সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
  • দ্বি-দলীয় রাজনীতির সূচনা: নির্বাচনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দ্বি-দলীয় ধারার সূচনা করে, যা পরবর্তী দশকগুলোতেও অব্যাহত থাকে।
  • শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর: নির্বাচনের পর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, কারণ প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এটি বর্জন করেছিল।

১. প্রেক্ষাপট

  • তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি: তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানায়।
  • মাগুরা-২ উপনির্বাচন: ১৯৯৪ সালের মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে, যা ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে বিরোধী দলগুলোর আশঙ্কাকে আরও দৃঢ় করে।
  • রাজনৈতিক সংকট: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। বিরোধী দলগুলো হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

২. ফলাফল

  • নির্বাচন বর্জন: আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রধান দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে।
  • ভোটের হার: ভোটার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম, মাত্র ২১%।
  • আসন সংখ্যা:
    • বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি): একতরফা নির্বাচনে ২৭৮টি আসনে বিজয়ী হয়।
    • অন্যান্য: ফ্রিডম পার্টি ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০টি আসন লাভ করে।

৩. রাজনৈতিক তাৎপর্য

  • রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: এই একতরফা নির্বাচন দেশকে তীব্র রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। দেশব্যাপী সহিংসতা ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে।
  • সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী: বিরোধী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাস করতে বাধ্য হয়, যার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে প্রবর্তন করা হয়।
  • সংসদ ভেঙে দেওয়া: ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ মাত্র ১২ দিনের কার্যদিবসের পর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং নতুন নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।

সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ বাতিলের পর সংবিধানের নতুন বিধান অনুযায়ী বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১. প্রেক্ষাপট

  • তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন: সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এটিই ছিল প্রথম জাতীয় নির্বাচন।
  • অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন: ষষ্ঠ নির্বাচনের বিপরীতে এই নির্বাচনে সকল প্রধান রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে, যা এটিকে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে পরিণত করে।
  • রাজনৈতিক উত্তেজনা: পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই নির্বাচন নিয়ে জনগণের ব্যাপক আগ্রহ ছিল।

২. ফলাফল

  • অংশগ্রহণকারী দল: ৮১টি রাজনৈতিক দল এবং ২৮১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ মোট ২,৫৭৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
  • ভোটের হার: নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল প্রায় ৭৫%।
  • আসন সংখ্যা:
    • বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ: ১৪৬টি আসন পেয়ে একক বৃহত্তম দলে পরিণত হয়।
    • বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি): ১১৬টি আসন লাভ করে।
    • জাতীয় পার্টি: ৩২টি আসন পায়।
    • বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী: ৩টি আসন লাভ করে।

আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে।

৩. রাজনৈতিক তাৎপর্য

  • তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কার্যকারিতা: এই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রমাণ করে এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করে।
  • ক্ষমতার পালাবদল: নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।
  • বিরোধী দলের ভূমিকা: বিএনপি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে সংসদে আবির্ভূত হয়, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০০১

বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনটিও একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হয়।

১. প্রেক্ষাপট

  • রাজনৈতিক জোট গঠন: নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট এবং জাতীয় পার্টি (নাজিউর) মিলে চারদলীয় জোট গঠন করে।
  • উন্নয়ন ও সুশাসন: আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং সুশাসনের বিষয়টি নির্বাচনের আলোচনায় প্রাধান্য পায়।
  • প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশ: নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান দুই জোটের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা লক্ষ্য করা যায় এবং দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা ছিল উৎসবমুখর।

২. ফলাফল

  • অংশগ্রহণকারী দল: ৫৪টি রাজনৈতিক দল এবং ৪৮৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ মোট ১,৯৩৫ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন।
  • ভোটের হার: নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল প্রায় ৭৫.৫৯%।
  • আসন সংখ্যা:
    • বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি): ১৯৩টি আসন পেয়ে এককভাবে বিশাল বিজয় অর্জন করে।
    • বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ: ৬২টি আসনে জয়ী হয়।
    • বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী: ১৭টি আসন লাভ করে।
    • ইসলামী জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট (জাতীয় পার্টি): ১৪টি আসন পায়।

চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে এবং বেগম খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

৩. রাজনৈতিক তাৎপর্য

  • ভূমিধস বিজয় ও জোটের রাজনীতি: চারদলীয় জোটের ভূমিধস বিজয় প্রমাণ করে যে, জোটবদ্ধ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কার্যকর কৌশল।
  • নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা: নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংস হামলার ঘটনা ঘটে, যা নির্বাচনকে কিছুটা বিতর্কিত করে।
  • রাজনৈতিক মেরুকরণ: এই নির্বাচনের ফলাফল দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে দূরত্ব ও অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে তোলে, যা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০০৮

একটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রায় দুই বছরের শাসনের পর ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনটি বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

১. প্রেক্ষাপট

  • এক-এগারোর পরিবর্তন: ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই সরকার দুর্নীতি দমন, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
  • রাজনৈতিক জোট: নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট (জাতীয় পার্টি, জাসদ ইত্যাদি) এবং বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠিত হয়।
  • 'দিনবদলের সনদ': আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে 'দিনবদলের সনদ' ঘোষণা করে, যা তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।

২. ফলাফল

  • ভোটের হার: নির্বাচনে ৮৬ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে, যা ছিল একটি রেকর্ড।
  • আসন সংখ্যা:
    • বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ: ২৩০টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
    • বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি): মাত্র ৩০টি আসন লাভ করে।
    • জাতীয় পার্টি: ২৭টি আসনে জয়ী হয়।

মহাজোটের এই বিশাল বিজয়ের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়।

৩. রাজনৈতিক তাৎপর্য

  • গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন: দুই বছরের জরুরি অবস্থার পর এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পুনরায় গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে।
  • নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ: আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় এবং বিএনপির ভরাডুবি দেশের রাজনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে।
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি: এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পরবর্তীতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪

সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১. প্রেক্ষাপট

  • তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল: ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোট এর তীব্র বিরোধিতা করে।
  • নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিতর্ক: বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, কিন্তু সরকার দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় থাকে।
  • নির্বাচন বর্জন: প্রধান বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে একটি একতরফা নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

২. ফলাফল

  • বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন: নির্বাচনের আগেই ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা ছিল अभूतপূর্ব।
  • অংশগ্রহণ: বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটসহ অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে।
  • আসন সংখ্যা:
    • বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ: ২৩৪টি আসন পেয়ে বিজয়ী হয়।
    • জাতীয় পার্টি (এরশাদ): ৩৪টি আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে।

৩. রাজনৈতিক তাৎপর্য

  • বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন: অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এই নির্বাচনটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়।
  • গণতন্ত্রের সংকট: একটি একতরফা নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করে তোলে।
  • দুর্বল বিরোধী দল: জাতীয় পার্টি সরকার ও বিরোধী দল উভয় ভূমিকায় থাকায় সংসদে একটি কার্যকর বিরোধী দলের অভাব দেখা যায়, যা সরকারের জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় দলীয় সরকারের অধীনেই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১. প্রেক্ষাপট

  • অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রচেষ্টা: ২০১৪ সালের নির্বাচনের বিতর্কের পর একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য চাপ ছিল। নির্বাচনের পূর্বে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিকে নিয়ে 'জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট' নামে একটি নতুন জোট গঠিত হয়।
  • রাজনৈতিক সমঝোতার অভাব: নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রধান দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি।
  • নির্বাচনী পরিবেশ: নির্বাচনের আগে ও ভোটের দিন বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

২. ফলাফল

  • অংশগ্রহণ: আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ নিবন্ধিত সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
  • আসন সংখ্যা:
    • বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ: ২৫৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
    • জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট: মাত্র ৭টি আসন (বিএনপি ৫টি ও গণফোরাম ২টি) লাভ করে।
    • জাতীয় পার্টি: ২২টি আসন পায়।

আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে।

৩. রাজনৈতিক তাৎপর্য

  • নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন: বিরোধী জোট নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে এবং 'রাতের ভোট'সহ ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে। আন্তর্জাতিক মহলও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
  • একদলীয় শাসনের দিকে যাত্রা: এই নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা আরও সুসংহত হয়, কিন্তু এটি দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি তৈরি করে, যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগজনক বলে বিবেচিত হয়।
  • রাজনৈতিক আস্থার সংকট: নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর বিরোধী দল এবং জনগণের একটি বড় অংশের আস্থার সংকট তৈরি হয়, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

উপসংহার

১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশটি গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় সাফল্য এবং সংকট—উভয়েরই সম্মুখীন হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো (পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম) তুলনামূলকভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে সহায়ক হয়েছিল। তবে, এই ব্যবস্থার বিলুপ্তির পর অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এই নির্বাচনগুলোর প্রেক্ষাপট, ফলাফল ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, যা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিপথ অনুধাবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

পড়ুন

The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা এই লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

পড়ুন