Skip to main content

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস হলো ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যকার টানাপোড়েনের ইতিহাস— ১৯৭২ থেকে বর্তমান পর্যন্ত সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনীর আলোকে উক্তিটি বিশ্লেষণ কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যকার এক দীর্ঘ ও জটিল টানাপোড়েনের চিত্র ফুটে ওঠে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, যা ছিল সদ্য স্বাধীন জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিফলন। কিন্তু এই আদর্শিক অবস্থান সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক স্রোতে পরিবর্তিত হয়েছে। সামরিক শাসন, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানে আনা হয়েছে একাধিক সংশোধনী, যা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে বারবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

বিশেষত, সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ধর্মীয় পরিচয়কে শক্তিশালী করা হয়, যা মূল সংবিধানের দর্শন থেকে একটি বড় পরিবর্তন ছিল। অন্যদিকে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করা হলেও একইসাথে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখা হয়, যা ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭২ থেকে বর্তমান পর্যন্ত সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনীর আলোকে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় রাজনীতির টানাপোড়েনের বিষয়টি বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

১৯৭২ সালের মূল সংবিধান: ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শিক ভিত্তি

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। এই সংবিধানের প্রস্তাবনায় এবং ৮নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি ঘোষণা করা হয়: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই মূলনীতিগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক বলিষ্ঠ প্রতিফলন, যা একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল।

১. ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক রূপ

১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রকে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত রাখা, কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা না দেওয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করা এবং যেকোনো ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ন বিলোপ করার কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে পৃথক রাখা এবং সকল নাগরিকের জন্য নিজ নিজ ধর্ম পালনের সমান স্বাধীনতা নিশ্চিত করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিল।

২. ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা

ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে শক্তিশালী করার জন্য মূল সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল, অতীতে ধর্মের নামে যে বিভেদ ও সহিংসতার রাজনীতি হয়েছে, তা থেকে নতুন রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখা এবং একটি সহনশীল ও বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। এই বিধানটি ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ, যা রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা প্রদান করে।

সুতরাং, ১৯৭২ সালের সংবিধান বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার আদর্শিক ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যেখানে ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় এবং রাষ্ট্র সকল নাগরিকের প্রতি নিরপেক্ষ থাকবে।

ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে বিচ্যুতি: পঞ্চম সংশোধনী

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সামরিক শাসনের অধীনে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়, যা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এই সংশোধনীটি ছিল মূল সংবিধানের আদর্শ থেকে একটি সুস্পষ্ট বিচ্যুতি।

১. 'বিসমিল্লাহির-রহমানির-রহিম' সংযোজন

১৯৭৭ সালে এক সামরিক ফরমানে সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে "বিসমিল্লাহির-রহমানির-রহিম" (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) সংযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়। এই সংযোজনটি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়কে পরিবর্তন করে একটি ধর্মীয় আবহ প্রদান করে, যা ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী।

২. ধর্মনিরপেক্ষতা বিলোপ ও 'আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা'

পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৮নং অনুচ্ছেদ থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' মূলনীতিটি বাদ দেওয়া হয় এবং এর পরিবর্তে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' কথাটি যুক্ত করা হয়। এর পাশাপাশি, ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক ১২নং অনুচ্ছেদটি সংবিধান থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আনুষ্ঠানিকভাবে অপসারিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

৩. ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনঃপ্রবর্তন

এই সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়। এর ফলে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক দলগুলোর पुनরুত্থান ঘটে, যা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। এই পরিবর্তনকে অনেকেই ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আদায়ের একটি কৌশল হিসেবে দেখে থাকেন।

২০০৫ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট এবং পরবর্তীতে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়, কারণ এটি একটি অসাংবিধানিক সামরিক শাসনের অধীনে করা হয়েছিল। আদালতের এই রায় সংবিধানকে ১৯৭২ সালের চেতনায় ফিরিয়ে নেওয়ার পথ প্রশস্ত করলেও, এর মধ্যে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে গভীর ছাপ রেখে যায়।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা: অষ্টম সংশোধনী

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক নির্ধারণে অষ্টম সংশোধনী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত পদক্ষেপ। ১৯৮৮ সালের ৭ জুন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে এই সংশোধনীটি আনা হয়, যার মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১. অনুচ্ছেদ ২(ক) সংযোজন

অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে একটি নতুন অনুচ্ছেদ, ২(ক), যুক্ত করা হয়। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়: "প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।" এই বিধানটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সংবিধানে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে, যা দেশের অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিতর্কের জন্ম দেয়।

২. রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য

তৎকালীন সামরিক সরকার তার শাসনের বৈধতা অর্জন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন লাভের একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে বলে মনে করা হয়। দেশে যখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল, তখন ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবেও এটিকে দেখা হয়। তৎকালীন সংসদে প্রধান বিরোধী দলগুলোর অনুপস্থিতিতে এই বিলটি ২৫৪-০ ভোটে পাস হয়।

৩. বিচার বিভাগীয় প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক

অষ্টম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৮৮ সালেই আদালতে একটি রিট আবেদন করা হয়েছিল। দীর্ঘ সময় পর, ২০১৬ সালে হাইকোর্ট রিটটি খারিজ করে দেয় এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখে। আদালত তার রায়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে বিবেচনার কথা উল্লেখ করে।

এই সংশোধনীটি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে বাংলাদেশকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মীয় পরিচয়ের ভূমিকাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। এটি সংবিধানের একটি মৌলিক চরিত্র পরিবর্তনের প্রচেষ্টা হিসেবে সমালোচিত হয়েছে এবং অদ্যাবধি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে একটি আলোচিত বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রত্যাবর্তন ও রাষ্ট্রধর্মের সহাবস্থান: পঞ্চদশ সংশোধনী

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়ন করে, যা বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে একটি জটিল ও পরস্পরবিরোধী অধ্যায়ের সূচনা করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে একদিকে যেমন ১৯৭২ সালের সংবিধানের কিছু মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হয়, তেমনি পূর্ববর্তী সংশোধনীগুলোর কিছু বিতর্কিত বিধানও বহাল রাখা হয়।

১. ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃस्थापन

পঞ্চদশ সংশোধনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র পুনঃस्थापन। সংবিধানের ৮নং অনুচ্ছেদে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও, বিলুপ্ত ১২নং অনুচ্ছেদটি পুনঃস্থাপন করে সাম্প্রদায়িকতা বিলোপ, কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা না দেওয়া এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করার বিধান ফিরিয়ে আনা হয়।

২. 'বিসমিল্লাহ' ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল

ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হলেও, সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে "বিসমিল্লাহির-রহমানির-রহিম" এবং অনুচ্ছেদ ২(ক)-তে বর্ণিত 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বিধানটি বহাল রাখা হয়। তবে রাষ্ট্রধর্মের অনুচ্ছেদটিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে বলা হয়: "প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।"

৩. সাংবিধানিক অসঙ্গতি ও বিতর্ক

একই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্মের মতো দুটি বিপরীতধর্মী ধারণার সহাবস্থান একটি বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সমালোচকদের মতে, রাষ্ট্রধর্মের وجود ধর্মনিরপেক্ষতার মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, রাষ্ট্র যখন কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়, তখন তা অন্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বৈষম্যের অনুভূতি তৈরি করতে পারে এবং সাংবিধানিকভাবে সকল নাগরিকের সমমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে পারে।

অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এই দুটি বিধানের সহাবস্থান বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন এবং এটি সকল ধর্মের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে। এই সংশোধনীটি ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যকার টানাপোড়েনকে একটি নতুন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র একই সাথে ধর্মনিরপেক্ষ এবং একটি নির্দিষ্ট ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। এই জটিল সাংবিধানিক ব্যবস্থা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।

উপসংহার

বাংলাদেশের ১৯৭২ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সাংবিধানিক পরিক্রমা এক অস্থিতিশীল পথচলার ইতিহাস, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এবং ধর্মীয় রাজনীতির বাস্তবতা প্রতিনিয়ত একে অপরের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল এবং অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ধর্মীয় পরিচয়কে শক্তিশালী করা হয়, যা মূল সংবিধানের দর্শন থেকে একটি বড় বিচ্যুতি ছিল।

পরবর্তীতে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, একইসাথে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত একটি সাংবিধানিক প্যারাডক্স বা আপাতविरोಧ তৈরি করেছে। এই দ্বৈত অবস্থান একদিকে যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান জানানোর একটি রাজনৈতিক প্রচেষ্টা, অন্যদিকে এটি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে দুর্বল করে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্যের আশঙ্কা তৈরি করে।

বস্তুত, বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যকার টানাপোড়েন শুধু একটি আইনি বা সাংবিধানিক বিতর্ক নয়, বরং এটি দেশের রাজনৈতিক আদর্শ, সামাজিক বাস্তবতা এবং ক্ষমতার সমীকরণের এক জটিল প্রতিফলন। এই চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনের ওপরই বাংলাদেশের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে ভবিষ্যৎ পথচলা অনেকাংশে নির্ভরশীল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

পড়ুন

The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা এই লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

পড়ুন