তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা (ত্রয়োদশ সংশোধনী) প্রবর্তনের কারণ এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিলের পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলো কী ছিল? বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এর প্রভাব সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত অধ্যায়। নব্বইয়ের দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং নির্বাচনকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তারের উদ্বেগের ফলস্বরূপ এই ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে ভোটাররা নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বাতিলের পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংবিধানিক যুক্তি রয়েছে, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এর প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে, এটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আজও চলমান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা (ত্রয়োদশ সংশোধনী) প্রবর্তনের কারণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পেছনে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ বিদ্যমান ছিল। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে স্বৈরাশাসনের অবসানের পর গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হলেও নির্বাচনকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দলগুলোর মধ্যে চরম আস্থাহীনতা এই ব্যবস্থার উত্থানকে ত্বরান্বিত করে।
১. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থাহীনতা
১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও প্রধান রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মধ্যে চরম недоверие ও বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কোনো দলই প্রতিপক্ষের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে আস্থাশীল ছিল না। ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে—এই আশঙ্কা বিরোধী দলগুলোর মধ্যে প্রবল ছিল।
২. ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবির পেছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে ১৯৯৪ সালের মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচন। এই নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করে যে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাটি বিরোধী দলগুলোর এই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এরপর থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি একটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়।
৩. বিরোধী দলগুলোর লাগাতার আন্দোলন
মাগুরা উপনির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৎকালীন বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং লাগাতার হরতাল, অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। তাদের মূল দাবি ছিল, সংবিধান সংশোধন করে একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান যুক্ত করতে হবে।
৪. ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচন
বিরোধী দলগুলোর দাবি উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকার একটি একতরফা নির্বাচন আয়োজন করে, যা প্রধান বিরোধী দলগুলো বর্জন করে। এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল নগণ্য এবং এটি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় এবং ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে প্রবর্তিত হয়। এই সংশোধনীর অধীনে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হিসেবে প্রশংসিত হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে যুক্তি
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এই বাতিলের সিদ্ধান্তের পেছনে সরকার ও এর সমর্থকরা বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপন করে, যার মধ্যে প্রধান ছিল सर्वोच्च আদালতের রায় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে এর অসামঞ্জস্যতা।
১. সর্বোচ্চ আদালতের রায়
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি হিসেবে দেখানো হয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়। ২০১১ সালের ১০ মে, সর্বোচ্চ আদালত এক রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করেন। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা দেশ শাসন সংবিধানের মৌলিক গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। যদিও আদালত দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা বিবেচনা করে পরবর্তী দুটি নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, সরকার পূর্ণাঙ্গ রায়ের ভিত্তিতে এই ব্যবস্থাটি বাতিল করে।
২. গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক
বাতিলের পক্ষের যুক্তি অনুসারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পৃথিবীর কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এমন ব্যবস্থা নেই যেখানে নির্বাচনের সময় একটি অনির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করে। এই ব্যবস্থাটি জনগণের সার্বভৌমত্বের নীতির পরিপন্থী, কারণ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার তাদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
৩. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কারণ হিসেবেও সমালোচিত হয়। বিশেষ করে ২০০৬-২০০৮ সময়কালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত। এই সরকার নির্ধারিত ৯০ দিনের পরিবর্তে প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল এবং দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাসহ বহু রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে।
৪. বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ
সংবিধান অনুযায়ী, সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতেন। এই বিধানটি বিচার বিভাগকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে এবং এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রধান বিচারপতির পদটিকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়, যা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিপক্ষে যুক্তি
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো এবং সুশীল সমাজের একটি বড় অংশ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। তাদের মতে, এই বাতিলের ফলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে।
১. অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা হারানো
বাতিলের বিরোধিতাকারীদের প্রধান যুক্তি হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন প্রায় অসম্ভব। ক্ষমতাসীন দল সবসময়ই প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, যা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এই প্রভাব থেকে নির্বাচনকে মুক্ত রাখার একটি কার্যকর প্রক্রিয়া ছিল। এর বাতিলের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো (২০১৪, ২০১৮) একতরফা ও বিতর্কিত হয়েছে, যা এই আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেছে।
২. রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত বৃদ্ধি
এই ব্যবস্থা বাতিলের ফলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও অবিশ্বাস আরও তীব্র হয়েছে। বিরোধী দলগুলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়, যার ফলে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত, সহিংসতা এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রধান বিরোধী জোট বর্জন করে এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
৩. জনগণের ভোটাধিকারের অবমূল্যায়ন
বিরোধীদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ফলে জনগণের ভোটাধিকারের অবমূল্যায়ন হয়েছে। যখন একটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক হয় না, তখন জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এর ফলে যে সরকার গঠিত হয়, তার প্রতি জনগণের আস্থা থাকে না এবং সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
৪. সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের খণ্ডিত ব্যাখ্যা
সমালোচকরা মনে করেন, সরকার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিয়েছে। আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বললেও দেশের স্থিতিশীলতার জন্য আরও দুটি নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে আয়োজনের সুপারিশ করেছিল। সরকার সেই সুপারিশ উপেক্ষা করে এবং তড়িঘড়ি করে ব্যবস্থাটি বাতিল করে, যা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্তের প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এর প্রভাব: একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন ও বাতিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী এবং মিশ্র প্রভাব ফেলেছে।
ইতিবাচক প্রভাব:
- অবাধ নির্বাচন: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলো তুলনামূলকভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এর ফলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছিল, যা বাংলাদেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।
- ভোটারদের আস্থা: এই ব্যবস্থার কারণে ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনের প্রতি আস্থা ফিরে এসেছিল। তারা নির্ভয়ে ভোট দিতে পেরেছিল এবং তাদের রায় প্রতিফলিত হয়েছিল, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে সহায়ক ছিল।
নেতিবাচক প্রভাব:
- রাজনৈতিক আস্থাহীনতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ: এই ব্যবস্থাটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক আস্থাহীনতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিশ্বাসযোগ্য করার পরিবর্তে একটি তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
- গণতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকাশ: একটি অনির্বাচিত ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা প্রমাণ করে যে, দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন) যথেষ্ট শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি।
- রাজনৈতিক সংকট: বাতিলের পর বাংলাদেশের রাজনীতি এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা, বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জন এবং বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়েছে, যা দেশের ভাবমূর্তিকেও ক্ষুণ্ণ করেছে।
- বিচার বিভাগের বিতর্কিত ভূমিকা: এই ব্যবস্থা বিচার বিভাগকে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসে এবং এর বাতিলের প্রক্রিয়াটিও বিচার বিভাগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার একটি উদাহরণ হিসেবে সমালোচিত হয়।
উপসংহার
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি অনন্য সংযোজন ছিল, যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এর প্রবর্তন যেমন ছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনের ফসল, তেমনি এর বাতিলও ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন। যদিও এই ব্যবস্থাটি গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, এটি বাংলাদেশের মতো একটি বিভাজিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সাময়িকভাবে স্থিতিশীলতা ও নির্বাচনী স্বচ্ছতা আনতে সক্ষম হয়েছিল।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিলের পর থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনগুলো তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে এবং রাজনৈতিক সংঘাত তীব্রতর হয়েছে। এর ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে এবং জনগণের ভোটাধিকারের গুরুত্ব কমে গেছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন কাঠামো তৈরির ওপর, যা সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এবং জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটাবে।
জেনারেল জিয়াউর রহমান (১৯৭৫-৮১) এবং জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের (১৯৮২-৯০) শাসনামলের একটি তুলনামূলক মূল্যায়ন কর। তাঁদের বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া, দল গঠন, প্রশাসনিক সংস্কার এবং গণতন্ত্রের উপর এর প্রভাব আলোচনা কর।
বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক ও ক্ষমতার ভারসাম্য আলোচনা কর। এই ভারসাম্য বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে?
সম্পর্কিত পোস্ট
একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা এই লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।