Skip to main content

বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি, বিকাশ এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা অর্জনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা ও নেতৃত্বের ভূমিকার একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা কর

মেফতাহুল তম্মীএকাডেমিক গবেষক ও লেখক

ভূমিকা

আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল এমন এক সংগঠিত জনসমষ্টি, যারা নির্দিষ্ট আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে সরকার গঠন করে এবং নিজেদের নীতি বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট থাকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলীয় ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনে রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থার একটি স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও ঐতিহাসিক বিকাশ রয়েছে, যা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে পাকিস্তান পর্ব পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই ব্যবস্থার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য, যেমন—বহুদলীয় কাঠামো, দ্বি-দলীয় আধিপত্য, ব্যক্তিত্ব-কেন্দ্রিক রাজনীতি এবং সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, একে একটি জটিল রূপ দিয়েছে।

তবে, দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা অনেকাংশে নির্ভর করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা এবং তাদের নেতৃত্বের ভূমিকার ওপর। এই দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অবস্থা এবং নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ও সমালোচনা রয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক যাত্রাকে প্রভাবিত করে।

এখানে বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি, বিকাশ এবং বৈশিষ্ট্যগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা অর্জনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা ও নেতৃত্বের ভূমিকার একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা করা হলো।

বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থার বিকাশ

বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থার বিকাশকে তিনটি প্রধান পর্বে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে: ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমল।

ব্রিটিশ আমল

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু হয়। এই সময়ে গঠিত দলগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অধিকার আদায় এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা অর্জন করা।

  • ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫): শুরুতে এটি একটি আবেদন-নিবেদনকারী সংগঠন থাকলেও পরবর্তীতে স্বাধীনতার প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়।
  • সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ (১৯০৬): মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এই দলটি পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই দলগুলোই মূলত এই অঞ্চলের মানুষকে সংগঠিত করে এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে, যা পরবর্তী সময়ের রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করে।

পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-১৯৭১)

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ দেখা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিক্রিয়ায় নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে।

  • আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৪৯): মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতাদের একাংশ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শামসুল হকের নেতৃত্বে এই দলটি গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে এটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক দলে রূপান্তর করা হয়, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।
  • ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) (১৯৫৭): মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে বামপন্থী ও প্রগতিশীল নেতারা ন্যাপ গঠন করেন। এই দলটি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার ছিল। এই সময়ের দলীয় রাজনীতি মূলত ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ প্রশস্ত করে।

বাংলাদেশ আমল (১৯৭১-বর্তমান)

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থা বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে।

  • একদলীয় শাসন (১৯৭৫): স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। তবে, ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় 'বাকশাল' (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
  • বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন: ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন (১৯৭৮), যা আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
  • সামরিক শাসন ও দল গঠন: ১৯৮২ সালে আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন এবং পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি (১৯৮৬) গঠন করেন।
  • দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার বিকাশ: ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের পর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে। এরপর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এই দুটি প্রধান দলের আধিপত্যের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে, যা একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার কিছু স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নিম্নে প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:

১. বহুদলীয় ব্যবস্থার উপস্থিতি

সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক এবং نظریاتগতভাবে যেকোনো দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। তবে, বাস্তবে রাজনীতি মূলত দুটি প্রধান রাজনৈতিক জোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

২. দ্বি-দলীয় রাজনীতির প্রবণতা

যদিও দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে, ১৯৯১ সালের পর থেকে জাতীয় রাজনীতি মূলত আওয়ামী লীগবিএনপি-কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এই দুটি দলই নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সরকার গঠন ও বিরোধী দলের ভূমিকা তারাই পালন করে আসছে। এর ফলে, একটি অঘোষিত দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা (De facto two-party system) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৩. আদর্শগত মেরুকরণ

বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে আদর্শগত বিভাজন বেশ স্পষ্ট।

  • আওয়ামী লীগ: দলটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রের মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
  • বিএনপি: দলটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ইসলামী মূল্যবোধ এবং ডানপন্থী অর্থনৈতিক নীতির ওপর জোর দেয়। এই আদর্শগত বিভাজন দেশের রাজনীতিতে একটি গভীর মেরুকরণ তৈরি করেছে, যা প্রায়শই সংঘাতের জন্ম দেয়।

৪. ব্যক্তিত্ব-কেন্দ্রিক রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর চেয়ে নেতা-কেন্দ্রিক। দলগুলোর নীতি, আদর্শ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে শীর্ষ নেতার প্রভাবই চূড়ান্ত। আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা, বিএনপিতে জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি দলের পরিচয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই ব্যক্তিত্ব-নির্ভরতার কারণে দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারেনি।

৫. দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ

প্রধান দলগুলো কয়েক দশক ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বেশ দুর্বল। দল পরিচালনা, প্রার্থী মনোনয়ন, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় গঠনতন্ত্রের চেয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছাই বেশি প্রাধান্য পায়। নিয়মিত কাউন্সিল বা সম্মেলন না হওয়া, তৃণমূলের মতামতের উপেক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতার অভাব দলগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্বল করে রেখেছে।

৬. জোটের রাজনীতি

নব্বইয়ের দশকের পর থেকে বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এককভাবে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের চ্যালেঞ্জ এবং ভোটের সমীকরণ মেলানোর জন্য প্রধান দলগুলো ছোট ছোট দলগুলোকে নিয়ে জোট গঠন করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে পূর্বে ২০ দলীয় জোট (বর্তমানে বিলুপ্ত) এর প্রধান উদাহরণ।

৭. সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতার অভাব প্রকট। রাজনৈতিক মতপার্থক্য প্রায়শই ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে চলে যায়। এর ফলে হরতাল, অবরোধ, সংসদ বর্জন, এবং রাজপথে সহিংসতা রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি সাধারণ অংশে পরিণত হয়েছে।

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা: একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা

গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা অপরিহার্য। কারণ, যে দল নিজের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক নয়, সে দল ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা অত্যন্ত দুর্বল এবং এটি দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

১. গঠনতন্ত্রের প্রয়োগহীনতা ও নামমাত্র কাউন্সিল

প্রায় প্রতিটি বড় দলের নিজস্ব গঠনতন্ত্র থাকলেও এর প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিয়মিত কাউন্সিল বা সম্মেলন আয়োজন করা হয় না। সম্মেলন হলেও সেখানে সাধারণত পূর্বনির্ধারিত নেতৃত্বকেই অনুমোদন দেওয়া হয়; নির্বাচন বা মতামতের কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে নেতৃত্ব নির্বাচনে তৃণমূলের কর্মীদের কোনো ভূমিকা থাকে না।

২. মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা

জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অভাব প্রকট। দলের সংসদীয় বোর্ড বা মনোনয়ন বোর্ড থাকলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে। তৃণমূলের মতামত বা জনপ্রিয়তার চেয়ে ব্যক্তিগত আনুগত্য, আর্থিক সামর্থ্য এবং পারিবারিক পরিচয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে।

৩. পরিবারতন্ত্রের প্রভাব

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র একটি গভীর বাস্তবতা। প্রধান দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব বংশানুক্রমিকভাবে একই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু পরিবারের এবং বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে শীর্ষ নেতৃত্বে আসা প্রায় অসম্ভব। এই পরিবারতান্ত্রিক সংস্কৃতি দলে নতুন নেতৃত্বের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে সংকুচিত করছে।

৪. কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একচ্ছত্র ক্ষমতা

দলীয় সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যেমন—জোট গঠন, নীতি নির্ধারণ, বা আন্দোলন কর্মসূচি—সবই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ দ্বারা গৃহীত হয়। দলের অন্যান্য স্তরের নেতাদের এ বিষয়ে মতামত প্রকাশের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এই এককেন্দ্রীক ক্ষমতা দলকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্বল করে এবং নেতৃত্বের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বৃদ্ধি করে।

৫. ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা

দলের অভ্যন্তরে ভিন্নমতকে দমন করার প্রবণতা অত্যন্ত প্রবল। শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের সমালোচনা বা বিরোধিতা করলে অনেক সময় দল থেকে বহিষ্কার বা কোণঠাসা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর ফলে দলে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়, যা মুক্ত আলোচনা ও বিতর্কের পথ বন্ধ করে দেয় এবং চাটুকারিতাকে উৎসাহিত করে।

গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা অর্জনে নেতৃত্বের ভূমিকা: একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা

একটি দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা বহুলাংশে নির্ভর করে তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং গণতান্ত্রিক আচরণের ওপর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক—উভয় দিকেই পর্যালোচনার দাবি রাখে।

ইতিবাচক ভূমিকা

  • ঐতিহাসিক অর্জন: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। তাঁরা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে বড় বড় পরিবর্তন সাধন করেছেন।
  • গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রাখা: নানা সংকট সত্ত্বেও নির্বাচন আয়োজন এবং ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ভূমিকা পালন করেছে।

নেতিবাচক ও সমালোচনামূলক দিক

  • সংঘাতময় রাজনীতির প্রসার: প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব প্রায়শই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সংঘাতকে উস্কে দিয়েছে। হরতাল, অবরোধ এবং সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে জনজীবন বিপর্যস্ত করা এবং জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এই অগণতান্ত্রিক আচরণ গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
  • রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা: ক্ষমতায় থাকাকালীন দলীয় স্বার্থে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিকীকরণের অভিযোগ রয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করেছে এবং আইনের শাসনকে দুর্বল করেছে, যা গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
  • অসহনশীলতা ও প্রতিশোধের রাজনীতি: এক পক্ষ অন্য পক্ষের প্রতি চরম অসহনশীল। নির্বাচনে হেরে গেলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা, সংসদ বর্জন করা এবং বিজয়ী দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা একটি সাধারণ প্রবণতা। এই প্রতিহিংসার রাজনীতি দেশে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে প্রধান অন্তরায়।
  • জনগণের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য: অনেক সময় জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থকে বড় করে দেখা হয়। নীতি নির্ধারণ বা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জনকল্যাণের চেয়ে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবই বেশি করা হয়, যা সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে।

উপসংহার

বাংলাদেশের দলীয় ব্যবস্থা একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমা শেষে বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় হলেও, বাস্তবে এটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেন্দ্রিক দ্বি-দলীয় আধিপত্যের রূপ নিয়েছে। ব্যক্তিত্ব-কেন্দ্রিকতা, আদর্শগত মেরুকরণ, দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং সংঘাতপূর্ণ সংস্কৃতি এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।

দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব এবং নেতৃত্বের অগণতান্ত্রিক আচরণ। পরিবারতন্ত্র, মনোনয়ন বাণিজ্যে অস্বচ্ছতা এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দলগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্বল করে রেখেছে। পাশাপাশি, নেতৃত্বের সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষয় করেছে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

সুতরাং, বাংলাদেশে একটি টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনা অপরিহার্য। নেতৃত্বকে আরও সহনশীল, দূরদর্শী এবং জাতীয় স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। দলের অভ্যন্তরে এবং জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমেই কেবল একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

পড়ুন

The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা এই লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

পড়ুন