বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা মূল্যায়ন কর। তারা কি সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পেরেছে নাকি কেবল সরকার পতনের আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থেকেছে? উদাহরণসহ বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকা
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দল একটি অপরিহার্য উপাদান। বিরোধী দলকে 'বিকল্প সরকার' বা 'ছায়া সরকার' হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এর প্রধান কাজ হলো সরকারের কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনা করা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরোধী দলের ভূমিকা বহুমাত্রিক এবং প্রায়শই বিতর্কিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিরোধী দলগুলো যেমন সরকারের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরেছে, তেমনি তাদের কার্যক্রম অনেক সময় শুধুমাত্র সরকার পতনের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে, বিরোধী দলের ভূমিকা প্রায়শই গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে সংঘাতমূলক রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিরোধী দলগুলো সংসদ বর্জন, হরতাল, অবরোধ এবং সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করেছে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী দল আইন প্রণয়নে এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকারকে সহযোগিতা করেছে। এই আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা মূল্যায়ন করা হবে এবং তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে কতটা সক্ষম হয়েছে বা কেবল সরকার পতনের আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, তা উদাহরণসহ বিশ্লেষণ করা হবে।
বিরোধী দলের তাত্ত্বিক ভূমিকা ও কার্যাবলী
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দল সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে এবং শাসনকার্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে গণতন্ত্র শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
বিরোধী দলের প্রধান কার্যাবলী
১. সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা: বিরোধী দলের অন্যতম প্রধান কাজ হলো সরকারের নীতি, কর্মসূচি এবং কার্যকলাপের গঠনমূলক সমালোচনা করা। এর মাধ্যমে সরকারের ভুল-ত্রুটি জনগণের সামনে তুলে ধরা হয় এবং সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
২. বিকল্প সরকার গঠন: বিরোধী দলকে 'ছায়া সরকার' বলা হয়, কারণ তারা পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুত থাকে। তারা বিকল্প নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে এবং জনমত গঠনে সহায়তা করে।
৩. আইন প্রণয়নে সহায়তা: সংসদে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিলের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করে এবং জনস্বার্থবিরোধী আইন পাসে বাধা প্রদান করে। প্রয়োজনে সরকারকে আইন প্রণয়নে সহায়তাও করে থাকে।
৪. জনগণের অধিকার রক্ষা: বিরোধী দল জনগণের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার থাকে। তারা সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং জনগণের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরে।
৫. সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ: একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি সরকারকে স্বৈরাচারী হতে বাধা দেয়। বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে সরকার সাধারণত জনবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
৬. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা: বিরোধী দল নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের বিরোধিতা করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করে। সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হলে রাজপথে সহিংসতা এড়ানো সম্ভব হয়।
৭. জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি: জাতীয় সংকটের সময়ে বিরোধী দল সরকারি দলের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারে, যা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলগুলো এই তাত্ত্বিক ভূমিকাগুলো পালনে বিভিন্ন সময়ে সফল এবং ব্যর্থ হয়েছে, যা পরবর্তী অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
গঠনমূলক সমালোচনা ও ইতিবাচক ভূমিকা: উদাহরণ ও বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরোধী দল সবসময়ই কেবল সরকার পতনের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিভিন্ন সময়ে তারা গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে এবং জাতীয় স্বার্থে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
ইতিবাচক ভূমিকার উদাহরণ
১. সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে সমর্থন: ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার যখন সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের জন্য সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করে, তখন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এই বিলকে সমর্থন জানিয়েছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল সহযোগিতার দৃষ্টান্ত, যা দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছিল।
২. জনগণের অধিকার বিষয়ে সোচ্চার: বিভিন্ন সময়ে বিরোধী দলগুলো জনগণের অধিকার, যেমন: মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার থেকেছে। তারা সরকারের বিভিন্ন নিপীড়নমূলক আইন ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদে এবং সংসদের বাইরে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
৩. পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে ভূমিকা: সুন্দরবন রক্ষা, নিরাপদ সড়ক এবং কোটা সংস্কারের মতো বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত আন্দোলনে বিরোধী দলগুলো নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
৪. দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা তুলে ধরা: বিরোধী দলগুলো প্রায়শই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরে। গণমাধ্যমে এবং সংসদে এ সকল বিষয় উত্থাপনের মাধ্যমে তারা সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা করে।
৫. সংসদীয় কমিটিতে অংশগ্রহণ: যখন বিরোধী দল সংসদে সক্রিয় থাকে, তখন তারা বিভিন্ন সংসদীয় কমিটিতে অংশগ্রহণ করে। এই কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম তদারকি করা এবং নীতি নির্ধারণে পরামর্শ প্রদান করা সম্ভব হয়।
যদিও এই উদাহরণগুলো বিরোধী দলের গঠনমূলক ভূমিকার প্রমাণ দেয়, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের সহযোগিতামূলক ও সমালোচনামূলক ভূমিকা প্রায়শই সংঘাতমূলক রাজনীতির কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি দলের অসহিষ্ণুতা এবং বিরোধী দলের নেতিবাচক মানসিকতা উভয়ই এর জন্য দায়ী।
সরকার পতনের আন্দোলন: উদাহরণ ও বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকার একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে সরকার পতনকেন্দ্রিক আন্দোলন। অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধী দলগুলো নিয়মতান্ত্রিক ও গঠনমূলক সমালোচনার পথ পরিহার করে রাজপথের সহিংস আন্দোলনকে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে।
সরকার পতন আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ
১. এরশাদবিরোধী আন্দোলন (১৯৮২-১৯৯০): হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। দীর্ঘ নয় বছরের এই আন্দোলনে হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ এবং গণ-অভ্যুত্থানের মতো কর্মসূচি পালিত হয়। অবশেষে ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই আন্দোলনকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একটি সফল উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়।
২. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন (১৯৯৪-১৯৯৬): ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনের উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের পর তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন তীব্র রূপ নিলে বিরোধী দলগুলো সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করে এবং একটানা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করে। অবশেষে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়।
৩. চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন (২০০১-২০০৬): ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করার পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী জোট বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন শুরু করে। এই সময়ে গ্রেনেড হামলা, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সর্বদলীয় দাবি আদায়ে ব্যর্থতার ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল পরবর্তী নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করা।
৪. আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন (২০০৯-২০২৪): ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এবং বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বিএনপি ও তার শরিক দলগুলো সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার চেষ্টাসহ বিভিন্ন সময়ে হরতাল, অবরোধ এবং সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। তবে এই আন্দোলনগুলো চূড়ান্ত সফলতা লাভ করতে পারেনি।
৫. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও সরকারের পতন (২০২৪): ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে প্রধান বিরোধী দলগুলো সমর্থন জানায় এবং এর ফলশ্রুতিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
এই উদাহরণগুলো থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো প্রায়শই নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে না পেরে এবং রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে সরকার পতনের আন্দোলনকে বেছে নিয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করেছে।
সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলো তাদের ভূমিকা পালনে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই ব্যর্থতাগুলো केवळ তাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণেই নয়, বরং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও প্রতিফলন।
বিরোধী দলের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা
১. সংসদকে অকার্যকর করা: বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর একটি সাধারণ প্রবণতা হলো সংসদ বর্জন করা। সামান্য অজুহাতে বা কৌশলগত কারণে দীর্ঘ সময় ধরে সংসদ বর্জন করার ফলে সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতে জনগণের সমস্যা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নষ্ট হয় এবং সরকার একতরফাভাবে আইন পাস করার সুযোগ পায়।
২. গঠনমূলক সমালোচনার অভাব: বিরোধী দলগুলো প্রায়শই সরকারের সকল কাজের বিরোধিতা করে থাকে, এমনকি ভালো উদ্যোগেরও সমালোচনা করে। নীতিভিত্তিক ও তথ্যনির্ভর গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং ঢালাও অভিযোগের রাজনীতি প্রাধান্য পায়।
৩. সহিংস ও ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি: দাবি আদায়ের উপায় হিসেবে হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের মতো সহিংস ও ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এর ফলে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে, অর্থনীতির ক্ষতি হয় এবং রাজনৈতিক পরিবেশ আরও সংঘাতময় হয়ে ওঠে।
৪. অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব: প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা অত্যন্ত সীমিত। শীর্ষ নেতৃত্বের একক সিদ্ধান্তে দল পরিচালিত হয় এবং নেতা-কর্মীদের মতামতের প্রতিফলন ঘটে না। এর ফলে দলের ভেতরে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না।
৫. নেতৃত্বের সংকট ও দুর্বল সংগঠন: অনেক সময় বিরোধী দলগুলো যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এবং দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। তৃণমূল পর্যায়ে কর্মীদের সাথে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমন্বয়ের অভাবও একটি বড় সমস্যা।
৬. বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা: অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে জনগণের ওপর নির্ভর না করে অনেক সময় বিরোধী দলগুলোকে বিদেশি শক্তির দ্বারস্থ হতে দেখা যায়। এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য যেমন হুমকিস্বরূপ, তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের দেউলিয়াত্বেরও পরিচায়ক।
৭. ধারাবাহিকতার অভাব: বিরোধী দলগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে ধারাবাহিক আন্দোলন বজায় রাখতে পারে না। ইস্যুভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে প্রায়শই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রাধান্য পায়, যা জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো প্রায়শই একটি দায়িত্বশীল ও কার্যকর বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, যা দেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা একটি মিশ্র চিত্র উপস্থাপন করে। একদিকে, স্বৈরাচার পতন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায়ে তাদের সফল আন্দোলন গণতন্ত্রের পথকে সুগম করেছে। অন্যদিকে, সংসদ বর্জন, সহিংস কর্মসূচি এবং শুধুমাত্র সরকার পতনের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে পরিচালিত রাজনীতি দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছে এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে।
বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনীর মতো জাতীয় ইস্যুতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও, গঠনমূলক সমালোচনার ধারা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পেছনে যেমন সরকারি দলের অসহিষ্ণু মনোভাব দায়ী, তেমনি বিরোধী দলের নেতিবাচক এবং সংঘাতমূলক রাজনীতিও সমানভাবে দায়ী। ফলে, বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল বিরোধী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
ভবিষ্যতে একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি ও বিরোধী উভয় দলকেই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতার চর্চা করতে হবে। বিরোধী দলকে যেমন ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথ পরিহার করে সংসদকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে, তেমনি সরকারকেও বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারে এবং জনগণের প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
The journey of the Bangladeshi Constitution is a journey of constant amendments reflecting the political turmoil of the nation. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিবর্তনের একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা কর।
ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলন কীভাবে স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করেছিল, তা বিস্তারিত আলোচনা কর।
সম্পর্কিত পোস্ট
একই বিষয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) একটি তুলনামূলক নীতি ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন কর।
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল (১৯৯১-৯৬) ও শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) নীতি ও কার্যক্রমের তুলনামূলক মূল্যায়ন। এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক সংস্কার, বৈদেশিক নীতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
The main challenge of democracy in Bangladesh is not the holding of elections, but the establishment of democratic institutions and culture. – এই উক্তিটির আলোকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ (যেমন: রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) আলোচনা কর।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, দুর্বল সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বাধাগ্রস্ত করছে তা এই লেখায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।